(দুর্বার, জানুয়ারি ২০১৬)
আমার কথা
আমার আদত বাড়ি কলকাতায় হলেও ২০০৭ সাল থেকে আমি চেন্নাইবাসী। ছোটবেলায় বন্যা মানে কয়েকটি ছুটির দিন এবং জল ছপছপিয়ে খেলার আনন্দই বুঝতাম। মাঝে বহু বছর বন্যা বলতে শুধুই টিভির খবরে ঘোলা জল ছিল। চেন্নাইয়ের এই ভীষণ বন্যা এই বিশেষ প্রাকৃতিক দুর্যোগটিকে অনেকটা কাছ থেকে দেখার সুবিধা করে দিল। ব্যক্তিগতভাবে আমার কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি। আবারও ছুটির আনন্দে ছপ ছপ করে ঘুরে বেড়িয়ে কাটালাম কয়েকটি দিন।
এই বন্যায় এক বিপুল সংখ্যক মানুষ ব্যাপক অর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন – তাঁরা সমাজের বিভিন্ন স্তরে বসবাস করেন। প্রাকৃতিক দুর্যোগের এই ব্যাপারটা মজার – এক অর্থে বিত্ত, পেশা, সামাজিক অবস্থান, লিঙ্গ ইত্যাদি তেমন কোনো গ্রাহ্য বিষয় নয়। আবার অন্যদিক দিয়ে দেখতে গেলে এই বৈশিষ্টগুলি মানুষকে যেকোনো রকমের দুর্যোগ থেকেই বাঁচার কিছু অতিরিক্ত সুবিধা বা অসুবিধা তৈরি করে দেয়। তার উপর কোনো মানুষের বা কোনো গোষ্ঠীর জীবনে ঘটে যাওয়া ঘটনা কখন সর্বজনগ্রাহ্যভাবে ‘দুর্যোগ’ তকমা পাবে, তারও মানদণ্ড হিসেবে এইজাতীয় নানা বৈশিষ্ট গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে।
চেন্নাইয়ের দুর্যোগে দেখা যাচ্ছে এমনকি বহু উচ্চবিত্ত মানুষেরও বাসভবন থাকার অযোগ্য হয়ে উঠেছে। দক্ষিণ চেন্নাইয়ের ভেলাচেরি থেকে শুরু করে বিস্তীর্ণ জলাভূমির উপর তৈরি যে ‘নব চেন্নাই’ – সেখানে জল প্রায় দোতলা অব্দি উঠেছে। উত্তর ও মধ্য চেন্নাইয়ের বহু এলাকা, টি-নগর, কোট্টুরপুরম, পোরুর, ভলসেরাবক্কম, আম্বাত্তুর ইত্যাদি বহু এলাকায় মানুষ বুক অব্দি উঁচু নর্দমা ও বৃষ্টির মিলেমিশে যাওয়া জল ঠেলে – স্কুলের পাঠ্যবইয়ে আঁকা বন্যার্ত গ্রামবাসীদের ছবির মত – মাথার উপর জামাকাপড়-বাসনপত্র-টিভি-কম্পিউটার-শিশুদের তুলে ধরে হেঁটে গেছেন শুকনো ডাঙার খোঁজে। হাতের কাছে রবার, হালকা বাক্স, কাঠের টুকরো, প্লাস্টিক এইসব যা পাওয়া গেছে তাই দিয়ে ছোট ছোট নৌকো বানিয়ে ত্রাণের কাজ করেছেন অনেকে, কিছু কিছু এলাকায় ওলা কোম্পানির রবারের নৌকো চলতে দেখা গেছে। রিসার্ভয়ারগুলি যেসব এলাকায় জল ধরে রাখতে না পারায় ওভারফ্লো করেছে, সেখানে দেখা গেছে বাইক চালাতে চালাতে কেউ কেউ জলের তোড়ে স্লিপ খেয়ে খালে পড়ে গেছেন এবং সম্ভবত মারাই গেছেন। টিভি ও সোশ্যাল মিডিয়ায় এসব ছবি বারবার দেখানো হয়েছে। তার ফলে যাঁরা অপেক্ষাকৃত উঁচু এলাকায় থাকায় এই সমস্যায় পড়েননি, অন্যান্য শহরে তাঁদের পরিবার-পরিজন খবর না পেয়ে উৎকণ্ঠিত হয়ে পড়েছেন। এর প্রধান কারণ দুর্যোগের প্রথম দু-তিন দিন প্রায় সমস্ত ল্যান্ড ফোন, মোবাইল ও ইন্টারনেটে যোগাযোগের রাস্তা বন্ধ ছিল।
যেমন আমি। আমি থাকি ইন্দিরা নগর বলে একটি জায়গায়, যেখানে কিছু রাস্তা জলমগ্ন হলেও বাকি রাস্তাগুলি বেশ শুকনো ছিল। তাই এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় যেতে হলে খানিকটা নোংরা হাঁটুজলে নামতে হয়েছিল বটে, বাকি শহরের মত এখানেও বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা বন্ধ থাকায় মোমবাতি আর টিউবওয়েলের জলে কাজ চালাতে হচ্ছিলও বটে, কিন্তু তা বাদে কোনো বড় রকমের সমস্যায় পড়তে হয়নি। তার উপর ফোন আর ইন্টারনেট কাজ না করায় বন্যার নানান ভয়াবহ সত্যিমিথ্যে দৃশ্য ও ঘটনা, যা অন্য শহরে মানুষ সহজেই দেখতে পাচ্ছিলেন, তার কিছুই দেখতে বা জানতে পারিনি। ফলে তেমন একটা দুশ্চিন্তাও হয়নি। পর্যাপ্ত গ্যাস থাকায় ভালমন্দ রান্না করে খেয়েছি, মোমের আলোয় বিস্তর গল্পের বই পড়েছি। অবশ্য ভাগ্যক্রমে আমার কাছে কয়েকদিনের জন্য যথেষ্ট খাবার ও পানীয় জল ছিল। যাঁদের তা ছিলনা, তাঁরা সমস্যায় পড়েছিলেন, কারণ রাতারাতি সমস্ত দোকান থেকে মিনারেল ওয়াটার, চাল, ময়দা, পাঁউরুটি, মোমবাতি, তেল, দুধ, তরিতরকারি – এই জিনিসগুলি উধাও হয়ে যায় আর বৃষ্টির কারণে সাপ্লাইও বন্ধ থাকে। শুনেছি শহরের কোথাও কোথাও এসব চড়া দামে বিক্রি করা হয়েছে, কিন্তু আমি প্রত্যক্ষে তেমন কিছু দেখিনি। যাঁরা রোজ কি ঘটছে না ঘটছে এ বিষয়ে বেশি ওয়াকিবহাল, তাঁরা নিশ্চয় এই দুর্যোগ সম্পর্কে আগেই খবর পেয়েছিলেন এবং দ্রুত প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র কিনে রেখেছিলেন। পরের দিকে, শহরে না মিললেও, শহরের বাইরের অঞ্চলগুলি থেকে দুধ, চাল, তরকারি আনার ব্যবস্থা করতে পেরেছিলেন অনেকে।
দুর্যোগের দ্বিতীয় দিন, অর্থাৎ ডিসেম্বরের ২ তারিখ সকালে ইন্দিরা নগর আর তার চারপাশের কয়েকটি অঞ্চলে প্রায় ঘণ্টা দেড়েক ঘুরে বেড়িয়েও মোমবাতি কিনতে পারলামনা। আশ্চর্যজনকভাবে যদিও তার আগের রাতেই এক-দেড় কিলোমিটার হেঁটে কোমরজল ভেঙে বাস-মেট্রো পাল্টে বাড়ি পৌঁছেছি, তবুও ওই মোমবাতির অভাবে প্রথমবার মনে হল আমার চারপাশের দৈনন্দিন পৃথিবীটা কোথাও একটা পাল্টে গেছে – যেমন হলিউডের ঘোরতর দুর্যোগবিষয়ক সিনেমাগুলিতে দেখানো হয় – র্যাট-ব্যাট-ভলক্যানো-টুইস্টার-বার্ডস এইসবে – যে এক রোদ-ঝলমলে সকালে, হিরো বা হিরোইন বা কেউ একজন বাড়ির বাইরে বেরিয়ে হয়তো বা রাস্তার একধারে একটা ছোট্ট ফাটল বা গাছের নীচে একটা পায়রা মরে পড়ে আছে দেখে খুব সূক্ষ্মভাবে বুঝতে শুরু করলেন (বা তিনি বুঝলেন না, কিন্তু দর্শক বুঝতে পারলেন) যে কি যেন একটা গোলমাল হতে চলেছে! এই হঠাৎ কখন আর পাঁচটা ঘনঘোর বর্ষার দিনের মতই একটা দিন ‘ডিজাস্টারে’ বদলে গেল এটা নিয়ে ব্যক্তিগত আত্মকথার সাত খণ্ড মোটা মোটা বই লিখে ফেলা যায়।
অস্বস্তির কথা
চেন্নাইয়ের এই দুর্যোগের বহুমাত্রিক ইতিহাসে আমার মোমবাতির অভাবজনিত দুশ্চিন্তার কোনো জায়গা আছে কিনা জানিনা; যদি বা থেকে থাকে তা একান্তই ব্যক্তিগত। সেই কারণেই ওই সিনেমার উদাহরণটা আরও বেশি লাগসই মনে হলো, কারণ হলিউড হোক বলিউড হোক, আধুনিক মেইনস্ট্রীম সিনেমা তৈরি হয় ব্যক্তিমানুষ ও তার সুখদুঃখ, আশাআকাঙ্ক্ষার জয়গানকে কেন্দ্র করে। এটা ইন্টারেস্টিং, কেননা এটা শুধুমাত্র সিনেমার রাজনীতি নয়, আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের রাজনীতি (ফলে স্বভাবতই বাণিজ্যিক সিনেমায় তার প্রতিফলন দেখা যায়)। তুচ্ছতম ঘটনার কারণ ও ফলাফলেরও নানা দিক থাকে, যা নির্ভর করে ব্যক্তি, বস্তু, গোষ্ঠী, দেশ, প্রকৃতি – সমস্ত কিছুর উপর, যে সমস্ত কিছু আবার পরস্পরের সাথে সম্পর্কিত। আমাদের বর্তমান উচ্চ বা মধ্যবিত্ত জীবনযাপনে একদিকে আমরা প্রতিনিয়ত এই সম্পর্কগুলিকে অস্বীকার করতে শিখি – যেন আমি নিজে বাদে বাকি সমস্তটাই পরিপ্রেক্ষিত! আমাদের মেইনস্ট্রীম সিনেমা-সাহিত্য ব্যক্তিকেন্দ্রিক – প্রায় নিউরোটিক বললেই হয়। চরিত্রগুলি তাদের চারপাশের পৃথিবীর সত্যিমিথ্যে ও ভালোমন্দের জটিলতা সম্বন্ধে পল্লবগ্রাহী এবং অসহিষ্ণু, অথচ অ-ক্রিটিকাল – কারণ তাদের স্রষ্টারাও অনেকাংশে তাই। এই সমস্যা আসলে গুরুতর, কারণ এ শুধু শিল্প-বিনোদনের ক্ষেত্রে থানা গেড়ে আছে তা নয়, আমাদের শিক্ষা, পেশা, ইচ্ছা, স্বপ্ন সবেতেই এর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। এর ফলে আমাদের সাধারণ বিচারবুদ্ধির প্রেক্ষিত তো বটেই, এমনকি আত্মবিচারের প্রেক্ষিতটিও সঙ্কীর্ণ হয়ে পড়ে। অথচ গোঁ নিয়ে অস্বীকার করতে চাইলেও প্রাত্যহিক বাস্তবে আমরা ওই সম্পর্কগুলিতে জটিলভাবে জড়িয়ে আছি – এটি একটি প্রাকৃতিক সত্য। অতিসরলীকরণের ঝুঁকি নিয়েও বলা যায়, যে এই দুটি পরস্পরবিরোধী সমান্তরাল জীবনদর্শন আমাদের রোজকার বেঁচে থাকার ভিতরে এক যৌক্তিক মিথ্যাচরণের জন্ম দেয়। এই কথাটি এই বন্যার প্রসঙ্গে বারবার মনে এলো।
এই বন্যার ভিতর দিয়ে ‘মিথ্যা’ বিষয়টা আমার ভিতর একটা দ্বিবিধ অস্বস্তির জায়গা তৈরি করেছে। এই অস্বস্তির হাসিঠাট্টার ভাগটা এসেছে আত্মীয়-বন্ধুদের উৎকণ্ঠার জবাব হাতড়ানোর মধ্যে দিয়ে। চাই বা না চাই, কয়েকজন কাছের মানুষ আমায় বন্যার্তের তালিকায় গণ্য করেছেন। আবার আমি নিজেও এই মনোযোগ উপভোগ করেছি – দুপুরে-রাত্তিরে বন্যাক্রান্ত শহরে জল ভেঙে একক অভিযানগুলি নিয়ে চোখ গোলগোল করে গল্প শুনিয়েছি, একরকমের গর্ববোধ করেছি বললেই হয়।
অস্বস্তির জটিল ভাগটি তৈরি হয়েছে এই বন্যায় আমার আপেক্ষিক অবস্থান বা ভূমিকার একটি সত্যিকারের মূল্যায়ন নিয়ে। বন্যাদুর্গত আমি, বন্যাদুর্গত অপর, ওদিকে আবার বন্যাত্রাতা আমি, বন্যাত্রাতা অপর, অর্থাৎ বন্যাদুর্গত যে আমি, সেই আমার ত্রাণকর্তা বা কর্ত্রী কারা ও কেন এবং আমিই বা আবার অপর কারুর ত্রাতা হয়ে ওঠার চেষ্টা করছি কিসের জন্য (এ যেন গীতা দত্তের ‘সুন্দর, জানোনা তো তুমি কে আমি কার! শোনোনি কি আমি কার তুমি কে! তুমি কার আমি কে…!’ ইত্যাদি) – এই প্রতিটি ভূমিকা নিয়েই যোগ্যতা ও সত্যতা বিষয়ক প্রশ্ন উঠতে পারে। তার কারণ এই ভূমিকাগুলিতে আমরা অধিকাংশজনই ইচ্ছেমতন ঢুকি-বেরোই, দায়িত্ব নিইনা, বা দায়িত্ব বস্তুটি সম্বন্ধে ভেবে দেখার প্রয়োজন উপলব্ধি করিনা।
অবশ্য আগেই বলেছি, এই দ্বিবিধ অস্বস্তি নিতান্তই ব্যক্তিগত। আপাতত সেই ব্যক্তিগত অবস্থান থেকেই নানা রিপোর্ট পড়ছি খবরের কাগজে, ইন্টারনেটে, ফেসবুকে আর থেকে থেকে চমৎকৃত, মুগ্ধ বা শিহরিত হচ্ছি। সেই রিপোর্টগুলির অধিকাংশেরই সাবটাইটেলে রয়েছে – ‘গ্রাউন্ড রিপোর্ট’ বা ‘ফ্রম অন দা গ্রাউন্ড’। পড়তে গিয়ে বারবারই মনে পড়ছে, ইন্দিরা নগরের সী লেভেল থেকে ভরসাজনক উচ্চতায় থাকা এই ফ্ল্যাটে আমি বরাবর গ্রাউন্ডের কয়েক হাত উপরেই ছিলাম।
এই ব্যক্তিগত অস্বস্তির বিষয়টা একটা রিপোর্ট বা আর্টিকেলের ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল। এজাতীয় মিশ্র অস্বস্তির অনুভূতি নিয়ে ফিল্ম-ক্রিটিক ভরদ্বাজ রঙ্গন হিন্দু মেট্রোপ্লাসে বিস্তর একথা ওকথা বলে শেষটায় লিখে ফেলেছেন –
“আমি এটা নিয়ে গুচ্ছের কথা বাড়াতে চাইনা, কিন্তু তাও আমার মনে হচ্ছে আমি এর মধ্যেই এটা নিয়ে অনেক কথা বলে ফেলেছি। আসলে এটা একটা নতুন অনুভূতি – বেঁচে যাওয়ার অপরাধবোধ। তাই হয়তো বা এটা নিয়ে কিছু কথা বলে যেতেই পারে।”
বন্যার কথা
দুর্যোগের গল্পে ফিরি। বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা সর্বত্রই অচল ছিল, তা নয়। শহরে মাথার উপর দিয়ে মেট্রো (MRTS) চলছিল (আর চলছিল বাস – নিঃশব্দে, মৃদুমন্দে, ঈশ্বর যেমন জলের উপর হাঁটেন), স্টেশনগুলিতে আলো ছিল, শহরের কোনো কোনো অঞ্চলে বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা দ্রুত কাজ করতে শুরু করে – বিশেষত যেসব অঞ্চলে ইলেকট্রিক অফিসে জল ঢুকতে পারেনি। এর বিপরীতে অবশ্য কয়েকটি এলাকায় শেষে রাস্তা অবরোধ-টোধ করে ইলেকট্রিক অফিস সারাইয়ের ব্যবস্থা করতে হয়। মাইকে চার্চের ‘মাস’ এবং মসজিদের আজান শুনতে পেয়েছি, সুপারমার্কেটগুলিতে কোথাও কোথাও আলো জ্বলছিল, যদিও ফ্রিজ কাজ করছিল না কোথাও, তাই অনেক খাবার নষ্ট হয়ে যায়।
আমার বাড়িটি ইন্সটিটিউট অফ ম্যাথেমেটিকাল সায়ান্সেস নামের একটি আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাত বিজ্ঞান ইন্সটিটিউটের কাছে। সেই ইন্সটিটিউটে জীবন মোটের উপর স্বাভাবিক ছিল – ব্যাক আপ ডিজেল জেনারেটরের সাহায্যে ও অ্যাটমিক এনার্জি বিভাগের দ্বারা প্রযোজিত হওয়ায় কিছু বিশেষ সুবিধা থাকার ফলে (এরই গা ঘেঁষে আইআইটি ম্যাড্রাসের অবস্থা ছিল অনেক বেশি শোচনীয়। তাইতে আমরা হাসাহাসি করছিলাম, ইঞ্জিনিয়াররা মরে মরুক গিয়ে, বিজ্ঞানীরা যেন দুধে ভাতে থাকে) আমি খানিক্ষণের জন্য সেখানে গিয়ে আমার ফোন এবং কম্পিউটার চার্জ করতে পেরেছিলাম। তবে ওখানে যাওয়ার রাস্তাটি – বহু বছর ধরেই দেখেছি – স্বল্প বৃষ্টিতেই জলমগ্ন হয়ে পড়ে। এবারে জল দেখলাম হাঁটু ছাড়িয়ে আরও উপর অব্দি উঠেছে। অস্বচ্ছ সেই ঘোলা জলের তলায় একটা বড়সড় গভীর জলের প্রাণী স্বচ্ছন্দে গুঁড়ি মেরে বসে থাকতে পারে। প্রায় তিনশ মিটার রাস্তা নানান ভয়ে সিঁটিয়ে, উরুর উপর প্যান্ট তুলে (এবারে লক্ষ্য করেছি বন্যার সময় পথচলতি মানুষ নারীজাতির পা কতটা দেখা গেল তা নিয়ে খানিকটা ছাড় দেন), উটকো ঢেউ তোলা গাড়িওয়ালার চোদ্দপুরুষ উদ্ধার করতে করতে ইন্সটিটিউট বিল্ডিঙে পৌঁছে দেখতে পেলাম আলো জ্বলছে, পাখা ঘুরছে, বাইরের পৃথিবীর সাথে যোগাযোগের রাস্তা হাট করে খোলা। জ্ঞানের আলো জিনিসটার এরকম আক্ষরিক উপযোগিতা দেখে ছোটবেলায় কেন আরও পড়াশুনো করিনি, তাই ভেবে মনটা মেদুর হয়ে গেল।
ওই ইন্সটিটিউটের রাস্তায় অনেক কুকুর-বিড়াল থাকে। তারা নিত্য পথচারী, ছাত্রছাত্রী বা চা-বিস্কুটওয়ালাদের হাপ-পোষা। তারই একটা কুকুরকে দেখলাম একটি বাড়ির কার্নিশে দাঁড়িয়ে করুণ চিৎকার করতে – নীচে বোধ করি তার ডুবজল। আবার ফেরার আগে শুনলাম ওই রাস্তায় গত সপ্তাহে একটা মাদী কুকুর গোটা চারেক বাচ্চা বিইয়েছিল। এমনি তারা বিইয়েই থাকে আর ফি সপ্তাহে মরেও একটা-দুটো – বেমক্কা গাড়ি চাপা পড়ে, না খেয়ে কিম্বা যা খেয়ে তা ভুল করে খেয়ে। কিন্তু সেদিন এই পাঁকজলের উপরে আবার পাছে ফুলেফেঁপে ঢোল কুকুরছানার মৃতদেহে পা জড়িয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি সেই আতঙ্কে কাঁটা হয়ে ফিরলাম। শেষ পর্যন্ত তেমন বীভৎস বিপাকে পড়তে হয়নি। তার জায়গায় দেখলাম একদল মানুষেরই ছানাকে, হৈ হৈ করে ওই মারাত্মক নোংরা জলেই হুটোপাটি করে খেলতে। এ ওর গায়ে জল ছিটিয়ে দিচ্ছে, ও একে ঠেলে ফেলে দিচ্ছে, সবার মুখে আত্মহারা হাসি। বন্যা বলে দু-তিন সপ্তাহ হলো স্কুল-কলেজ-অফিস ছুটি (স্কুল-কলেজগুলি অনেক জায়গাতেই রিলিফ ক্যাম্পে পরিণত হয়েছে)। তাই তাদের চকচকে চোখে নিত্য-রবিবারের অবাক আনন্দ। ছোটবেলা এইভাবে বিদঘুটে আনাচ কানাচ দিয়ে ফিরে আসে!
বন্যা নেমে গেলেই সমস্যার অবসান নয়। বাড়িতে জল ঢুকে যাওয়া এবং বিদ্যুতের সমস্যা ছাড়াও যাঁদের ওভারহেড ট্যাঙ্ক নেই, তাঁদের রোজকার ব্যবহার্য জল দূষিত হয়ে পড়েছে। স্যানিটারি কর্মচারীরা কাজে আসছেননা বা আসতে পারছেননা, তাই বাড়ির বাইরের ডাস্টবিন উপচে জলে পচা নানারকমের নোংরা বাড়ির চারদিকের ল্যান্ডস্কেপ পাল্টে দিয়েছে। অনেকের গাড়ি ভেসে চলে গেছে। সেই গাড়ি ফেরত এলেও তা চলবে কি চলবেনা তা বোঝা যাচ্ছেনা। অনেকে আবার আত্মীয়স্বজন, বন্ধুবান্ধুবের বাড়িতে থাকছেন। কিন্তু নিজের বাড়িতে না থাকার নানান সমস্যা, যা বলে বা লিখে বোঝানো যায়না, তা তাঁদের সহ্য করতে হচ্ছে। এই সমস্যাগুলির হাত থেকে বন্যার পরেও চট করে মুক্তি নেই। এছাড়া নানা বন্যাজনিত অসুখের সম্ভাবনা বাড়ছে, যদিও এখনো কোনো অসুখ তেমন মহামারীর রূপ ধারণ করেনি। অন্যদিকে নানা বস্তিতে বা রিলিফ ক্যাম্পে থাকা মানুষ পেটের ও চামড়ার অসুখে এবং নানা ইনফেকশনে ভুগছেন। রিলিফ মেডিকাল ক্যাম্পগুলিতে এঁদের চিকিৎসা হচ্ছে খানিকটা, বাকিটা ভাগ্যের হাতে।
জবরদখল-কথা
শুরুতেই যা বলছিলাম – দুর্যোগের তকমার এক নিজস্ব রাজনীতি আছে। একটি দুর্যোগ কতটা সাড়া ফেলবে তা নির্ভর করে সেই অঞ্চলটির স্ট্যাটাসের উপর, কারা ক্ষতিগ্রস্ত হলেন তার উপরেও, বিশেষ করে ‘ছোটোখাটো’ দুর্যোগ, যাতে গ্রামাঞ্চলবাসী, চাষী, জেলে বা অন্যান্য প্রান্তবাসী মানুষই শুধু ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকেন, সেসবের কথা আমরা জানতে পারিনা – এই জানতে না পারার পিছনের কারণগুলি রাজনৈতিক ভাবে বহুমাত্রিক। চেন্নাই একটি মেট্রোসিটি। মধ্য ও উচ্চবিত্ত – উঁচু ক্লাস ও উঁচু কাস্টের বহু মানুষকে আক্ষরিক অর্থে জলে ফেলে দিয়েছে এবারের এই বন্যা। আইটি অফিস, এয়ারপোর্ট, সিনেমা-ইন্ডাস্ট্রি – এইসব নাম, যা সাধারণত ‘দুর্যোগ’ শব্দটির সাথে তত ঘন ঘন উঠে আসেনা – তারা জায়গা পেয়ে গেছে দুর্যোগের ইতিহাসে। এসব দেখে আশা করলেও করা যায়, যে আমাদের মত মানুষেরা, যারা দুর্যোগের প্রশ্নে মোটের উপর শুধুই দর্শকের ভূমিকা পালন করে থাকি, তারা ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার সমস্যাটা এবার হয়তো একটু আলাদাভাবে বুঝতে চাইব, বুঝতে পারব। যেমন চেন্নাইয়ের এক সিনেমা স্টার সিদ্ধার্থ্, যাঁর নিজের বাড়ি জলমগ্ন হয়েছে এবং যিনি নানান রিলিফের কাজে গত কয়েক সপ্তাহ ধরে শহরের ভিতরে ও বাইরে বিভিন্ন প্রান্তে দৌড়ে বেড়াচ্ছেন। তিনি এনডিটিভিকে দেওয়া ইন্টার্ভিউতে বলেছেন যে তাঁর নিজের বাড়ির এই অবস্থা হওয়াতেই হয়তো তিনি এইভাবে মাঠে নেমে পড়তে পেরেছেন, বা চেয়েছেন। এইভাবে ত্রাণের কাজে মাঠে নেমেছেন বহু মানুষই। দুর্যোগের সময় দৌড়োদৌড়ি করে ত্রাণের কাজ করার প্রয়োজনীয়তা অনেক। কিন্তু তা সত্ত্বেও কেন জানি মনে হয় সেখানেই যদি দায়িত্ব ফুরিয়ে যায়, তাহলে সে শুধু বালির বাঁধ – তা সে পরকে জানাই হোক, বা নিজেকে বোঝাই হোক।
মেট্রো সিটি হলেও চেন্নাই যে এই তকমা পাওয়ার লিস্টের মাথায় রয়েছে তেমনটি নয় – সেটি বৃহত্তর জাতীয় রাজনীতির প্রশ্ন। ন্যাশনাল মিডিয়ার নজর টানতে চেন্নাইয়ের বন্যার যা সময় লেগেছে, হয়তো মুম্বই বা দিল্লির তত সময় লাগতনা – এরকমটাও অনেকে মনে করেছেন। আসলে যেদিক থেকেই দেখা হোক না কেন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ শুধু প্রাকৃতিক দুর্যোগমাত্রই নয়। এর পিছনের কারণ, গতিপ্রকৃতি ও ফলাফল – সবই নানা বৃহত্তর রাজনীতির সাথে যুক্ত।
এর মধ্যে সকলেই জেনে গেছেন চেন্নাইয়ের এই বন্যার অনেকটাই ‘ম্যান-মেড’। চেম্বারাবাক্কম লেক, যার জল আডিয়ার নদীতে (যাকে নদী বলা বাতুলতা) পড়ে এই বন্যার সূত্রপাত ঘটায়, তার খাতে ও কাছাকাছি বহু এলাকায় গাড়ি তৈরির ব্যবসা এবং আইটি কোম্পানির দহরম মহরম, খাস হুণ্ডাইয়ের ফ্যাক্টরি যার মধ্যে একটি। ফলে ছোট হয়ে আসছে জলাশয়, জলধারণ ক্ষমতা কমে যাচ্ছে, জলজ উদ্ভিদ ও প্রাণী লুপ্ত হচ্ছে দ্রুতবেগে। শহরের মাঝ দিয়ে ৪০০ কিমি দীর্ঘ ব্রিটিশ সরকারসৃষ্ট বাকিংহাম ক্যানাল এখন একটি ড্রেন মাত্র। বিভিন্ন অঞ্চলে তার গতি আটকে এবং তার ধার বরাবর রাস্তা বাড়িয়ে ভারী ট্রান্সপোর্ট চালানোর ব্যবস্থা হয়েছে। ৪ ও ৪৫ নং ন্যাশনাল হাইওয়ে জুড়তে গড়ে উঠেছে চেন্নাই বাইপাস, উত্তর চেন্নাইয়ের মদুরাভয়াল (১২০ একর থেকে যা আজ ২৫ একরের কাছাকাছি) ও অন্যান্য ট্যাঙ্কগুলির বড় অংশ বুজিয়ে। ব্রিটিশ আমলে ঘণ্টায় ৬ মিমি বৃষ্টির হিসেবে যে ড্রেনেজ ব্যবস্থা তৈরি হয়েছিল, আজ ঘণ্টায় ৪৭ মিমি বৃষ্টির অভিজ্ঞতা সত্ত্বেও সে ব্যবস্থার বড় একটা বদল হয়নি। তাই প্রতি বর্ষাতেই চেন্নাইতে সেই একই জল জমার গল্প। কোট্টুরপুরমের কাছে আডিয়ার নদীর রিসার্ভয়ারের ওভারফ্লো এবং বাকিংহাম ক্যানালের তীরবর্তী বস্তি অঞ্চলের অবস্থা – দুইই ভয়াবহ। কুভম নদী, যার তীরের বসতির বৃহদংশ আজ নিশ্চিহ্ন, আসলে একটি পচা ডোবা মাত্র।
বিভিন্ন বস্তি এলাকার মানুষদের নামে সরকার থেকে যে ত্রাণ ও ক্ষতিপূরণ ধার্য হয়েছে তার পরিমাণ এবং পরিকাঠামো দুয়েরই খোঁজ করে পরিষ্কার কিছু জানা যাচ্ছেনা। কিছু ক্ষেত্রে শোনা যাচ্ছে এই ক্ষতিপূরণ হাতে পাবেন বস্তির বাড়িওয়ালারা যাঁরা অনেকেই নিজেরা বস্তিবাসী নন আদৌ। রাজ্য-সরকার থেকে গোটা শহরের মানুষকেই বাড়িপিছু পাঁচ হাজার টাকা দেওয়া হবে বলে জানানো হয়েছে (আমিও তক্কে তক্কে ছিলুম কারণ ফ্রিজ থেকে যা খাবার ফেলতে হয়েছিল তারই দাম পাঁচশ টাকার কম নয়! কিন্তু আমার এক বন্ধু ‘মুড়িমুড়কির এক দর কচ্ছে, যাদের সত্যি সব গেছে তাদের না দিয়ে তোর মত বুর্জোয়া চুষুন্ডিদের পহা বিলোচ্ছে’ এইসব বলে গাল পাড়ল বলে সই করতে যাওয়া হলোনা। রাজার উপর রাগ করল সে, মাটিতে ভাত খেলাম আমি – কপাল আর কাকে বলে)।
সাইক্লোন, নদী ও সমুদ্রের খাতে প্লাস্টিক ও অন্যান্য বর্জ্য জমাকরণ এবং জলাভূমি বুজিয়ে উন্নয়নের পয়ে বন্যা জায়গায়-জায়গায় ভয়াবহ রূপ নিয়েছিল। এই শেষের সমস্যাটি নিয়ে আরও বিস্তারিত বর্ণনার প্রয়োজন আছে। ওল্ড মহাবলিপুরম রোডের ধার ঘেঁষে, ভেলাচেরি ও ওক্কিয়ামপেট্টাই থোরাইপাক্কমের মাঝে পল্লীকরণাই জলা অঞ্চলের কথা মনে আসছে, যার বুকের উপর কগনিজ্যান্ট ও আরও বহু আইটি বহুতল গড়ে উঠেছে এবং ফলত যা স্বাভাবিকভাবেই সবচাইতে বন্যাবিধ্বস্ত অঞ্চলগুলির মধ্যে একটি। অন্যদিকে রাজ্যে আধুনিকীকরণের শিকার বহু উচ্ছিন্ন বস্তির মানুষ এইসব এলাকায় সরকারি ও বেসরকারি কলোনি গড়ে তুলেছেন, তা মূল শহর থেকে সরকারি বহিষ্করণের ফলেও বটে, আবার ইন্ডাস্ট্রি ও ফ্যাক্টরিগুলি এই এলাকায় থাকায় জীবিকার কারণেও বটে। ফলে এইসব সুবিশাল জলাভূমি বিষাক্ত বর্জ্য, ড্রেনেজ, কন্সট্রাকশন এবং নতুন নতুন রাস্তা ও বসতি তৈরির চাপে ছোট হয়ে আসছে। পল্লীকরণাই জলা অঞ্চলটি যেমন ২৫০ বর্গকিমি থেকে এখন মোটে ৪-৫ বর্গকিমিতে এসে ঠেকেছে। এমনকি একে শেষমেশ ‘অভয়ারণ্য’ ঘোষণা করে উন্নয়নের হাত থেকে বাঁচাবার বৃথা চেষ্টা করা হচ্ছে। আরও দক্ষিণে তিরুপ্পোরুর তালুকে ঝাঁ চকচকে জাপান নগর বানাতে দেড় হাজার একর জমিতে জঙ্গল ও আদিবাসী বসতি সাফ করা হচ্ছে গত দু-আড়াই বছর ধরে। মূল শহর থেকে মাত্র পঞ্চাশ কিমি দূরে এই অঞ্চলটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য চোখে পড়ার মত – এখানে অনেকগুলি লেক ও আরেকটি অভয়ারণ্য রয়েছে। জাপান নগর নির্মাণের কাজে এইসব লেক থেকে নির্বিচারে বালি তুলে নেওয়া হয় – ফলে এই লেকগুলিতে জল প্রায় শুকিয়ে গেছে। ওদিকে অনেকসময় নানা দলিত গোষ্ঠী বা ‘ইরুলা’দের মত আদিবাসী সম্প্রদায় ক্রমবর্ধমান শহর ও জাতভেদের চাপে কোণঠাসা হতে হতে শেষে এইসব লেকের খাতে, অর্থাৎ লো ল্যান্ডে গিয়ে বাসা বাঁধতে বাধ্য হন। ওই অঞ্চলের কয়েকটি শুষ্কপ্রায় লেক এবারে বন্যার পর উপচে গিয়ে চারদিক ভাসিয়ে দিয়েছে। ত্রাণের কাজে গিয়ে অনেকেই দেখেছেন জাপান নগরের স্যান্ডমাইনিঙের শিকার সিতেরি লেকের ঠিক মাঝখানে মাথা তুলে ভাসছে ইরুলা কুঁড়েঘর। এই শ্রেণীর ঘরহারা মানুষদের সমস্যার শুরু ও শেষ বন্যা দিয়ে হিসেব করা যায়না।
এই একই জবরদখলের কাহিনী দক্ষিণ চেন্নাইয়ের বিস্তীর্ণ জলাভূমি অঞ্চলের সর্বত্র। ম্যাড্রাস হাই কোর্টকে পাঠানো সিএমডিএর রিপোর্ট থেকে দেখা যায়, চেন্নাই ও তার সংলগ্ন অঞ্চলে প্রায় ৩০০ জলাভূমি ধ্বংস করে দেড় লাখের কাছাকাছি বেআইনি কারখানা, বাড়িঘর, অফিস ইত্যাদি স্ট্রাকচার বানানো হয়েছে। এসবের উপর মাথার উপর রাজা হয়ে আছে দূষণ আর গ্লোবাল ওয়ার্মিং। তবে শুধু চেন্নাইকে খুঁড়ে লাভ নেই, উন্নয়নের রাজনীতি প্রতিটি রাজ্যে, মায় গোটা পৃথিবীতেই এক।
উন্নয়নের কথা
উন্নয়নের রাজনীতির সাথে অঙ্গাঙ্গী জড়িয়ে আছে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতার রাজনীতি তথা আমাদের দোকলা জীবনযাপন। কথার কথা বলছি, ধরুন কোনো একটা ক্যানালের ধারে একটা সরু রাস্তার দুপাশে ছোট ছোট বেআইনি চায়ের দোকান আছে। এই বৃষ্টির পর তাঁদের মধ্যে বেশিরভাগ দোকানী আর দোকান খুলতে ফিরে এলেননা, কারণ বন্যায় তাঁদের সব ভেসে গেছে (যে ইন্সটিটিউটের কথা আগে বলেছি, সেই রাস্তাতেই এ ঘটনা ঘটেছে এক চা-ওয়ালার সাথে। ছাত্ররা চাঁদা করে সেই ভদ্রলোককে কয়েক হাজার টাকা তুলে দিতেও পেরেছেন)। এবার ওই রাস্তাটি নিরঙ্কুশভাবে সরকারকে বর্তাল। ফলে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ঘাড়ে ভর করে, উচ্ছেদের জাল-জটিলতায় না পড়েই সরকার একটা গোটাগুটি রাস্তা হাতে পেয়ে গেল। আরও ধরুন ওই চায়ের দোকানসমৃদ্ধ রাস্তাটি একটা বড় আইটি কোম্পানির মেইন গেটের কাছে। তা আইটির ছেলেগুলি এবার চা খায় কোথায়? কোনো একটি ঝাঁ চকচকে রেডিমেড চা-কফি বিক্রির কোম্পানি ওই এলাকায় ব্যবসা বাড়াতে চেয়ে তাক করে ছিল। অথচ অত বড় দোকান তৈরির জন্য রাস্তাটি বেশ ছোট। তখন তাদের সাথে পহা-কড়ির ব্যাপারটা ঠিকঠাক করে নিয়ে সরকার থেকেই রাস্তাটি বেআইনি ভাবে ভেঙে, বেআইনিভাবে তার ধারের ক্যানালের একাংশ বুজিয়ে, প্রয়োজন মত গাছপালা কেটে রাস্তার বহর বাড়িয়ে নিয়ে নতুন দোকানের পথ পরিষ্কার করে ফেলা হল। এতে এই রাস্তায়, যেখানে হয়তো আগে অটো ঢুকত কি ঢুকত না, ব্যাপকভাবে গাড়িঘোড়া চলতে শুরু করল। রাস্তাটি দেখতেও আগের চেয়ে অনেক বেশি নয়নাভিরাম হলো। ক্যানালটি ক্রমশ একটি জলধারামাত্রে পরিণত হল যেখানে লোকে প্লাস্টিকের কাপ, সিগারেটের প্যাকেট, স্যানিটারি ন্যাপকিন ইত্যাদি আবর্জনা ফেলে ভরিয়ে তুলতে লাগল। এবার ধরুন আমি বা আপনি ওই আইটি কোম্পানিতে কাজ করি, কিন্তু কর্পোরেট হলেও আমরা মানবিকভাবে সচেতন ও সমাজচিন্তক। যদি সরকার থেকে ওই ছোট দোকানগুলিকে উচ্ছেদ করে এই পুরো কর্মপদ্ধতিটি কার্যকর করার চেষ্টা করা হত, ওই ছোট দোকানদারেরা স্বাভাবিকভাবেই বাধা দেওয়ার চেষ্টা করতেন, এবং আপনি বা আমি তাই নিয়ে হরতাল না করলেও হয়তো ফেসবুকে গালাগালি পাড়তাম। এতে ঝুটঝামেলার সম্ভাবনা থেকে যেত, হয়তো বা ঝাঁ চকচকে কোম্পানিটি এসব কূটকচালিতে পড়তে না চেয়ে পাত্তাড়ি গুটিয়ে অন্য এলাকায় পারি দিত। কিন্তু প্রকৃতির মারের উপর তো কারুর হাত নেই! বৃষ্টি এবং বন্যা সরকারকে এই বাড়তি সুবিধাটুকু করে দিল। আমরা শুধু যে কোনো আপত্তি জানালাম না তা নয়, দশগুণ মূল্য দিয়ে চা খাবার আহ্লাদে, আমার-আপনার অফিস এবং বহুজাতিক চা কোম্পানির দোকানটির ভিতরকার আরামদায়ক এসি, তার মেঝের ফ্লোরাল-ফিনাইল-পরিচ্ছন্নতা এবং এই সমস্ত কিছু মিলিয়ে যে উন্নয়ন, তার সাফল্যে ‘তোমার জয় তো আমারই জয়’ বলে আটখানা হলাম!
এই যে সব্বনাশের মাথায় বাড়ি – যার হাঁয়ের মাপ উপরের এই উদাহরণটির চেয়ে লক্ষ লক্ষ গুণ বড় – এটিই উন্নয়নের খিড়কির দরজা – কিন্তু এ হলো, যাকে বলে ‘বলা বারণ’, সাংবাদিক রবীশ কুমার যেমন আজকাল দেশের মসলাদার খবর রিপোর্ট করার পর ফিশফিশ করে বলেন – ‘এসব কাউকে বলবেন না, বাইরের দেশের লোকে শুনলে নিন্দে করবে’। চেন্নাইয়ের এই বন্যার রাজনীতির এটি একটি প্রধান মুখ – যেমন বলেছেন সাংবাদিক অ্যাকটিভিস্ট নিত্যানন্দ জয়রামণ নিউজমিন্টে তাঁর একটি লেখায় –
”জানুয়ারি মাসে, শুকনো আবহাওয়া ফিরলে পরে, এই বন্যা এক স্মৃতিমাত্র হয়ে থাকবে। দরদী মানুষজন লাফ দিয়ে বন্যার্ত গৃহহীন মানুষের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। অথচ যখন কুভম নদীর তীরে সৌন্দর্যকরণের জন্য মানুষকে উচ্ছেদ করা হয় (২০০৮ সাল থেকে এই নদীর ধারে একাধিকবার বস্তি উচ্ছেদ হয়েছে এবং এদের মধ্যে এক বড় অংশের পুনর্বাসন করা হয়নি রেশন কার্ড নেই – এই অজুহাতে), আমরা বসে বসে দেখি, এমনকি জলাভূমি পরিচ্ছন্ন করা হচ্ছে, এই বলে হাততালি দিই।
আমরা নিশ্চিত হয়ে বলতে পারি, জল সরে গেলে, মানুষ যখন তাঁদের জীবন নতুন করে শুরু করবেন, তামিলনাডু সরকার এই বন্যাকে অজুহাত হিসেবে ব্যবহার করে কয়েকটি বিশেষ অঞ্চলের অনধিকারী বসতি উচ্ছেদ করবে। গরিব মানুষের অনধিকারই শুধু অনধিকার বলে গণ্য হবে, বড় মানুষদের অনধিকার দেখেও দেখা হবেনা, বা তাকে মেনে নেওয়াই হবে।
অনধিকার বসতি স্থাপন বা এনক্রোচমেন্ট আমরা শুধু আইনি ভাষাতেই হিসেব করে থাকি। প্রকৃতি সূক্ষ্ম আইনি খুঁটিনাটি মেনে অনধিকার বিচার করেনা। একটি প্রাকৃতিকভাবে বিপজ্জনক জমির উপর সম্পূর্ণ আইনসম্মতভাবে একটি বাড়ি তৈরি করা হলেও তা প্রকৃতির বিচারে এনক্রোচমেন্ট। বাকিংহাম ক্যানালের গা দিয়ে তৈরি এমআরটিএস মেট্রো লাইন এক এনক্রোচমেন্ট। জলাভূমির উপর তৈরি মাদুরাই হাই কোর্ট একটি এনক্রোচমেন্ট।”
একটা প্রশ্ন বারবার উঠে আসে, যে এই এনক্রোচমেন্টের বিপরীত বাস্তবসম্মত পথটা কি? প্রকৃতির ভাগে ভাগ না বসিয়ে বা সভ্যতার প্রগতির বিচারে যাঁরা ‘প্রিমিটিভ’ অথবা ‘পিছিয়ে পড়া’ তাঁদের ঝেড়ে না ফেলেও জীবনযাত্রা সহজতর ও স্বচ্ছলতর করে তোলার রাস্তাটি কেমন? এই প্রশ্ন ওঠে কারণ সহজ ও স্বচ্ছল জীবন এবং ‘এগিয়ে যাওয়া’ সম্পর্কে আমাদের নানান পূর্বনির্ধারিত ধারণা রয়েছে, যা কিনা আবার খতিয়ে দেখলে মানবিকতার মূল পূর্বনির্ধারিত ধারণাগুলির সাথে পরস্পরবিরোধী, অর্থাৎ আবারও সেই যৌক্তিক অসঙ্গতি, যার শিকড় অনেক, অনেক গভীর! চেন্নাইয়ের বন্যার মত ‘ম্যান-মেড’ দুর্যোগ হয়তো এই নানান পূর্বনির্ধারিত ধারণার পুনর্মূল্যায়নের একটি বিরল সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। কিন্তু তত্ত্বগত মূল্যায়ন আর সেই তত্ত্ব সত্যি সত্যি কাজে লাগাতে পারার মধ্যে লক্ষ যোজন ফাঁক।
শুধু কারখানা ও আইটি করিডোর নয়, কলেজ ইউনিভার্সিটির অর্থাৎ জ্ঞানের আলোরও ছড়াছড়ি এই জলাভূমি এনক্রোচমেন্টের তালিকায়। উতান্ডির ইন্ডিয়ান মেরিটাইম ইউনিভার্সিটি, কোভালম ক্রিকের রিসর্ট ব্যাবসা, সিপকট, শোলিঙ্গনাল্লুরের বিরাট আইটি এসইজেড, মায় ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অফ ওশেন টেকনোলজি অব্দি সেই একই দোষে দোষী। এখনও, বন্যা থেমে যাবার সপ্তাহখানেক বাদেও, জলমগ্ন সত্যভামা ইউনিভার্সিটির মত কিছু বহুতলসমৃদ্ধ ক্যাম্পাস বন্যার বহুদিন বাদেও এনক্রোচমেন্টের প্রমাণ দিয়ে চলেছে হাতেনাতে। কিন্তু ফল ভুগছে শুধু যে এই কলেজ বা অফিসগুলি তা তো নয়। তাদের কর্মচারীদের ছুটির আনন্দ বা কার্যনির্বাহের আপাত সমস্যা ভর করে আছে ওই অঞ্চলের বন্যাদুর্গত জনবসতির শোচনীয় অবস্থার উপর।
চেন্নাইতে অক্টোবর থেকে ডিসেম্বরের এই দ্বিতীয় বর্ষায় গড়ে যা বৃষ্টি হয়ে থাকে এবছর এক মাসের মধ্যে তার চেয়ে ২০০ মিমিরও বেশি বৃষ্টি হয়েছে। ৩৫০-এর কাছাকাছি মানুষ মারা গেছেন। ডিসেম্বরের ২ থেকে ৬-এর মধ্যে এই শহরকে ‘ডিজাস্টার এরিয়া’ বলে ঘোষণা করা হয়। আর্মি, নেভি ও এয়ারফোর্স ত্রাণের কাজ শুরু করে। এয়ারপোর্টে বড় বড় প্লেনকে জাহাজের মত ভাসতে দেখা যায়। চেন্নাই শহর এই দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত ছিলনা। সম্ভবত এদেশের কোনো শহরই এই মাপের দুর্যোগের জন্য প্রস্তুত নয়। ২০১৪ সালে সিএমডিএর এক ইঞ্জিনিয়ারের ‘কনফেশন লেটার’ থেকে জানা যায় চেন্নাইয়ের কোয়েম্বেডুর একটি বহু কোটি টাকার স্টর্মওয়াটার ড্রেনেজ প্রজেক্টে সিমেন্টের বদলে ভেজাল ব্যবহার করা হয় এবং কিভাবে সিএমডিএর উঁচু লেভেলে তা প্রায় সর্বজনবিদিত। এজাতীয় প্রজেক্টের অনেকগুলিই শুরু হয়ে আর শেষ হয়নি, হয়না। প্রজেক্টগুলি বহু ভুল তথ্যদোষেও দুষ্ট। এবারের বন্যায় আর পাঁচটা নীচু অঞ্চলের মত কোয়েম্বেডুও যে বিপজ্জনকভাবে জলমগ্ন হয়ে পড়েছিল, তাতে তাই বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই।
ত্রাণ-কথা
দুর্যোগের রাজনীতি ত্রাণ-রাজনীতিকে বাদ দিয়ে অসম্পূর্ণ। সেন্টার থেকে মোদী সরকারের সাড়ে নশো কোটি টাকার ত্রাণ এবং নানা বৈদেশিক সহায়তা ছাড়াও দলে দলে সাধারণ মানুষ এই ত্রাণকার্যে হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। বিভিন্ন বাণিজ্যিক কোম্পানি তাদের মত করে বিশেষ সাহায্য দেওয়ার চেষ্টা করছে (তার মধ্যে ভোডাফোন থেকে দেখছি কথা বলবার জন্য নিখরচার সময় ধার্য করেছে, কিন্তু হায়, সে শুধু অপরাপর ভোডাফোন নম্বরে)। অন্যান্য শহর থেকে সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে বহু মানুষ একজোট হয়ে নানান পথে পোশাক, খাবার ও আশ্রয়ের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। এই ত্রাণ অবশ্য কারা পাবেন বা না পাবেন তার হিসেব ভিন্ন শহরের ত্রাতাদের পক্ষে রাখা সম্ভব না। এটা রাখতে পারেন একমাত্র তাঁরাই, যাঁরা ‘গ্রাউন্ডে’ থেকে ত্রাণ সংকলন ও বিতরণের কাজ করেছেন। আমার বাড়িতে জমানো জল ফুরিয়ে যাবার পর, যখন টিউবওয়েলের জলে রান্না করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকলনা, আমি তখন দিন তিনেকের জন্য পাশের শহর ব্যাঙ্গালোরে পালিয়েছিলাম। সেসময় দেখলাম ওখানে অনেকে বিভিন্ন চ্যানেলের মাধ্যমে জামাকাপড়, ওষুধ ইত্যাদি পাঠাচ্ছেন। এমনকি তাঁদের ক্ষমতায় যতটা সম্ভব, সেইমত চেন্নাই থেকে পালিয়ে আসতে বাধ্য হওয়া মানুষদের জন্য তাঁরা শেল্টারেরও বন্দোবস্ত করার চেষ্টা করছেন।
চেন্নাই ফিরে ত্রাণ-ব্যবস্থার সাথে যুক্ত মানুষদের সাথে কথা বলে বোধ জন্মাল যে আমার মত এলিট পলাতকদের বসবাসের ব্যবস্থা করা এক কথা, আর বন্যায় উদ্বাস্তু ‘নীচতলার’ মানুষগুলির রিলোকেশনের বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ আরেক কথা। এই মানুষেরা সমাজের নানা মাপকাঠিতে গ্রাউন্ডের কয়েক হাত নীচেই বসবাস করেন সারা বছর – আজীবন। এক অর্থে তাঁরা এই বন্যার হাতে সবচাইতে বেশি মার খেয়েছেন, কারণ তাঁদের আত্মরক্ষার সুযোগসুবিধা ও ক্ষমতা প্রায় শূন্য, তাঁরা অনেকেই এখন একেবারেই গৃহহীন এবং ত্রাণমুখাপেক্ষী। আবার আরেক অর্থে, তাঁদের বন্যার আগের ও পরের অবস্থা সমান ভয়াবহ। তাই তাঁদের ক্ষয়ক্ষতির মাপকাঠি আলাদা। প্রায় কিছু না থাকা ও কিছুই না থাকার তফাৎ কতখানি? অন্যদিকে কাডালুরের আম্বেদকর নগরের মত সুনামি ও বন্যা অধ্যুষিত দলিত গ্রামগুলি এবারের বন্যায় যথারীতি ভেসে যাওয়া সত্ত্বেও এক মাসের উপর বাইরের জগত ঠেকে বিচ্ছিন্ন হয়েছিল। গ্রামগুলিকে ঘিরে উঁচু জাতের মানুষের বসতির পাঁচিল, গ্রামগুলি বিষয়ে ব্রাহ্মণ্য সরকারের ঔদাসীন্যের পাঁচিল, মিডিয়া আর সোশ্যাল মিডিয়ার অজ্ঞতার পাঁচিল ডিঙিয়ে এখনও এসব অঞ্চলের কোথাও কোথাও কোনো ত্রাণ পৌঁছে উঠতে পারেনি।
তবে আমার মত অস্বস্তিকর অবস্থায় না পড়তে চাইলে, এই কথাটা মাথায় রেখে খেলতে নামা ভালো যে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই – সে আমাদের ব্যক্তিকেন্দ্রিক, অতিস্বচ্ছলতাকেন্দ্রিক জীবনযাত্রার কল্যাণেই হোক আর যাই হোক – ত্রাণ পৌঁছলেও আদত সমস্যার বিন্দুমাত্র হেরফের হয়না। আমার কয়েকজন পরিচিত মানুষ টিএন লেবার (tnlabour.in) নামে একটি ব্লগ চালান এবং ভারতবর্ষের শ্রমিকশ্রেণীর ইতিহাস-ভূগোল-সমাজনীতি-রাজনীতি আলোচনার পাশাপাশি অন্যান্য নানা বামপন্থী দল ও সংস্থার সাথে কাঁধ মিলিয়ে বিভিন্ন ছোট ছোট আন্দোলনের চেষ্টা করে থাকেন। আমার বাসস্থানের কাছেই একটি মেট্রো স্টেশনের পিছনে নারিকুরাভা অর্থাৎ জিপসিশ্রেণীর বস্তি। এখানে কাজ করতে গেলে উপলব্ধি হয়, যে আজকের বন্যা এবং সেই বন্যায় এঁদের যা অবস্থা, বাকি বছর জুড়েও এঁরা সেই একই রকমের ভয়াবহ অবস্থায় থাকেন। দারিদ্র্য, অশিক্ষা, অস্বাস্থ্য, অস্বীকৃতি – এ সমস্তকিছুর শিকার জিপসিরা চেন্নাইয়ের সমাজের নিম্নতম শ্রেণীগুলির মধ্যে একটি। আবর্জনা কুড়িয়ে, ভিক্ষা করে ও কিছু পরিমাণে পুঁতির গয়না টয়না বিক্রি করে তাঁরা জীবনযাপন করেন। তেমনই এক বস্তিতে প্লাস্টিকের মাদুর আর চাদর জোগান দিচ্ছিলেন টিএন লেবারের কিছু সদস্য। ব্যাঙ্গালোর থেকে ফিরে আমি এই রিলিফ পকেটটিতে কয়েক দিন হাজিরা দিই। আডিয়ার এলবি রোড সংলগ্ন একটি মসজিদ বন্যার ক’দিন আগাগোড়া আড়াইশো মানুষের খাবার সংস্থান করছিল – আরও নানা মসজিদ, চার্চ, রামকৃষ্ণ মিশন ও অন্যান্য কয়েকটি মন্দিরও যেমন নানাভাবে ত্রাণ ব্যবস্থায় বড় ভূমিকা নিয়েছিল। এই মসজিদ থেকে নারিকুরাভা বস্তিতে খাবারের জোগান দেওয়া হয় এবং ত্রাণকর্মীদের গাড়ির ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়। সরকার থেকে এই বস্তিগুলিতে তখন অব্দি কোনো রিলিফের ব্যবস্থা করা হয়নি।
সরকারের কথায় ভালো মনে পড়ল, রিলিফের কাজে ক্ষমতাসীন রাজনৈতিক দল এআইডিএমকের নির্লজ্জ আত্মপ্রচার ত্রাণকর্মীদের কাছে একটা হাসির ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছিল! আমার এক কলিগ প্রভু মনি চেটপেট ব্রিজের নীচে রিলিফের কাজ সম্পাদনা করছিলেন। ওখানকার জলমগ্ন বস্তিতে খাবারের প্যাকেট পৌঁছে দেওয়ার সময় এআইডিএমকের ক্যাডাররা দ্রুত ওই প্যাকেটগুলিতে প্রধানমন্ত্রী জয়ললিতার ছবি সাঁটিয়ে দিতে থাকেন, যাতে ত্রাণ ব্যবস্থাটিকে সরকারি তকমা লাগিয়ে দেওয়া যায়। ক’দিন থেকে আবার সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন মানুষকে ফোন করে রেকর্ড করা কণ্ঠে শোনানো হচ্ছে বন্যায় কারণে মুখ্যমন্ত্রী জয়ললিতা কতখানি দুঃখিত, কিন্তু তার ভিতরেও তাঁর আনন্দ এই যে ত্রাণ পাওয়া মানুষ ‘আম্মা আম্মা’ বলে সর্বত্র তাঁর নামগান করছেন! এজাতীয় উদ্ভট ঘটনা ঘটেছে এবং ঘটে চলেছে শহরের সর্বত্র। তা বলে সরকারি ক্যাম্পগুলি থেকে কোনো সাহায্যই পাওয়া যায়নি তা ঠিক নয়।
এআইডিএমকে সরকারের কথায় আরেকটি আন্দোলনের গল্প এপ্রসঙ্গে বলতে হয় – ২০১৫-রই জুলাই-অগাস্ট মাসের অ্যান্টি-লিকার আন্দোলন। প্রভুর অভিজ্ঞতা থেকেই কথাটা প্রথম উঠল কারণ চেটপেট ব্রিজের নীচের বস্তিতে খাবার বিলি করতে গিয়ে প্রভু ও তার বন্ধুদের সাথে এলাকার পেঁচি মাতালদের প্রায় হাতাহাতি লাগার জোগাড়। যে শহরে বন্যার ঠেলায় খাবার জলের হাহাকার সেখানে সারাদিন প্রায় সমস্ত মদের দোকান খোলা ছিল। এই টাসম্যাক (TASMAC – তামিলনাডু স্টেট মার্কেটিং কর্পোরেশন লিমিটেড) বা সরকারি মদের দোকান এই রাজ্যের এক মজার জিনিস। এই দোকানগুলি থেকে বছরে প্রায় ২৫০০০ কোটি টাকার মদ বিক্রি হয় এবং তাতে কয়েক হাজার কোটি টাকার ট্যাক্স ও ডিউটি উঠে আসে। এআইডিএমকে ও ডিএমকে এই দুই দলই এই ব্যবসা প্রোমোট করে। রাজ্যের নিম্নবিত্ত মানুষের মধ্যে – বিশেষত শ্রমিকশ্রেণীর ভিতর মদের নেশা এ রাজ্যে প্রায় এক অভিশাপের মত। বিভিন্ন বস্তি অঞ্চলে নেশা ও তদ্জনিত অশান্তি, অসুখ ও অপরাধের সমাধানের চেষ্টায় এ বছরেই তামিলনাডুর বিভিন্ন স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রী এবং বামপন্থী দলগুলির একত্র উদ্যোগে এই আন্দোলন গড়ে ওঠে, যার জেরে এই দোকানগুলি মাসখানেক বন্ধও থাকে। কিছু দোকান ভাঙচুর হয়, পুলিশি মারধোর ও ধরপাকড় মাত্রা ছাড়িয়ে যায়, গান্ধীবাদী অনশনকারী শশী পেরুমলের মৃত্যু ঘটে – সে যাকে বলে একটা মারকাটারি অবস্থা – অবশ্য এখন আবার অবস্থা যে কে সেই। বন্যার সময় ঢালাও মদ বিক্রি তামিলনাডুর এই অবস্থারই প্রতিচ্ছবি। কিন্তু বন্যা প্রসঙ্গে এই দৃশ্যের আরেকটি দিক উঠে এল অ্যাকটিভিস্ট শ্রীলা মনোহরের জবানীতে ও তাঁর আরেক অ্যাকটিভিস্ট বন্ধুর টুইটার পোস্টে। শ্রীলা ও তাঁর বন্ধু সক্রিয়ভাবে অ্যান্টি-লিকার আন্দোলনের সাথে যুক্ত ছিলেন। তাই তাঁদের এই উপলব্ধি আরও অসহায় –
“মানুষকে খাবার আর জল জোগান দেওয়ার কাজটা সহজ ছিল। পচতে থাকা আবর্জনা সাফ করাটাই ছিল কঠিন – বিশেষত জাতবিষয়ক জটিলতা থাকায়। তাই এক বিকেলে আমি সাফাইয়ের কাজে গেলাম এই ভেবে যে রবারের জুতো আর গ্লাভস থাকলে হয়তো কাজটা তত কঠিন হবেনা। কিন্তু আবর্জনার পাহাড় দেখে আমার মনের ভাব পাল্টে গেল। কর্পোরেশনের কর্মীরা ওখানে কাজ করছিলেন। কিন্তু আবর্জনার পরিমাণ এতটাই বেশি ছিল যে এই কাজ কখনো শেষ হতে পারে বলে মনে হচ্ছিলনা। একজন কর্মী আমার দিকে খানিকটা সহানুভূতির সাথেই তাকিয়ে বললেন ‘এইজন্য আমরা মদ খেয়ে কাজ করতে আসি, তা নয়তো এই আবর্জনায় হাত লাগানো মুশকিল।‘ আমি কি বলব ভেবে পেলামনা। লোকটি আমায় বললেন মদ কেনার জন্য কিছু টাকা দিতে। আমি তাঁকে ৫০০ টাকা দিয়ে সেখান থেকে চলে এলাম। আমরা এখন এই জায়গায় এসে দাঁড়িয়েছি। নিজেদের আবর্জনা আমরা নিজেরা পরিষ্কার করতে অক্ষম এবং এই কাজের জন্য একদল নীচতলার মানুষকে লাগিয়ে দিয়েছি, যাঁদের পক্ষে মদ না খেয়ে এই দুর্গন্ধ সহ্য করা প্রায় অসম্ভব। কর্মীদের মধ্যে আরেকজনকে দেখলাম, যাঁকে কারুর (চেন্নাই থেকে প্রায় ৪৩০ কিমি দূরে) থেকে তুলে আনা হয়েছে তার আগের রাতেই (কারণ চেন্নাইতে এই কাজের জন্য লোক পাওয়া যাচ্ছেনা)। হাল ছেড়ে দেওয়ার লজ্জা বমির মত এখন আমার সাথে লেগে আছে। এবং এর দুর্গন্ধ টিকবে আরও অনেক বেশি দিন।”
নামমাত্র মাইনেতে, অবশ্য-প্রয়োজনীয় বুট, গ্লাভস ও ওষুধপত্র ছাড়াই শয়ে শয়ে দলিত, বিভিন্ন আদিবাসী ও অন্যান্য শিডিউল কাস্ট শ্রেণীর মানুষেরা এই কাজ করে থাকেন। বন্যাপরবর্তী আস্তাকুঁড়গুলির পাশ দিয়ে যাওয়াই আজ এক সমস্যার কথা; সেই জায়গায় শহর পরিচ্ছন্ন করার কাজ করেন যাঁরা, তাঁদের কাজের সাথে ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর বড় একটা তফাৎ নেই। প্রসঙ্গত এই ম্যানুয়াল স্ক্যাভেঞ্জিং-এর কাজও করেন মূলত দলিত ও আদিবাসী শ্রেণী। কেন – এই প্রশ্নের উত্তর আবারও বহুমুখী। ‘ওরাই বা কেন ও কাজ করতে যায়’ এটুকু বলেই যে দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়া যায় না সেটা বুঝতে আমাদের অসুবিধা থাকার কথা নয়। স্যানিটারি কর্মীদের একাংশ আবার রাজ্যের বাইরে থেকে আনা মাইগ্রান্ট শ্রমিক। তাঁদের বসবাসের জায়গাগুলি অবর্ণনীয় রকমের নোংরা। জলের সমস্যা এই রাজ্যের সর্বত্র এবং এই ধরণের বস্তিগুলিতে সারা বছর জল প্রায় পাওয়া যায় না বললেই হয়। বস্তিপিছু একটি বা দুটি টিউবওয়েলের জলে কাজ চলে। আবার এই মুহূর্তে দক্ষিণ চেন্নাইয়ের মাইগ্রান্ট শ্রমিক বস্তিগুলিও একইভাবে জলমগ্ন। বসবাসের জায়গার মালিকানা বা যথাযথ কাগজপত্র না থাকার অজুহাতে তাঁদের ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা অনেক ক্ষেত্রেই পুরোপুরি অন্ধকারে রেখেছেন সরকারি কর্মচারীরা।
যাই হোক যা বলছিলাম – আমরা ছিলাম নারিকুরাভা বস্তিতে, প্লাস্টিকের মাদুর আর মোটা চাদর হাতে। গলির দুপাশে ভীষণ, ভীষণ নোংরা ষাটটি নারিকুরাভা পরিবারের শতখানেক মানুষ, সারা গায়ে নানান উল্কি, অনেকেরই চোখ টকটকে লাল – আসবে না আদতে তা বলা মুশকিল। বাড়ির উঠোনে কোথাও মরা ইঁদুর, কোথাও পাঁক, কোথাও চর্বির টুকরোয় মাছি ভনভন, বন্যার রেশ। ওঁরা প্রায় সক্কলে চামড়ার অসুখে ভোগেন। এমনিতেই। আর এখন বন্যা আর পোকামাকড়ের কল্যাণে আরও বেশি। নারিকুরাভারা কথা বলেন হিন্দি-তামিল-মারাঠি-তেলেগু মেশানো নিজস্ব এক ভাষায়, পরিষ্কার জায়গায় যাবার আশাতেও মোটেও (আবার) উচ্ছিন্ন হতে রাজি নন। নাচ-গান খুব পছন্দের জিনিস (আমাদের এক বন্ধুর নাম বিজয় বলতেই ওঁদের তরুণদল কোমর বেঁধে ফিল্ম অ্যাক্টর বিজয়ের নাচ দেখিয়ে দিলেন)। ওঁরা কাউকে বিশ্বাস করেননা – সরকারকে, আমাদেরকে বা পরস্পরকে। বলেন – সব্বাই চোর, সব মিথ্যে কথা বলে। তাই নিয়ম করে প্রত্যেকটা বাড়িতে হাতে ধরে মাদুর-চাদর দিয়ে এলে তবে কতকটা শান্তি। প্রথম দিন মসজিদের কর্মীরা খানিক ধমকে ধামকে হাতে রাখছিলেন ব্যাপারটা। পরের দিন শুধু আমরা দুটি প্রাণী মিলে মিনমিন করে হিসেবপত্তর দেখাতে যেতেই আর সে জিপসি জলতরঙ্গ থামায় কে! আমরা তো আর ওঁদের মুখ মনে করে রাখিনি। তাই এক-এক বাড়ি থেকে খানিকটা গলার জোরে আর খানিকটা বড় বড় নখ দিয়ে খিমচে তিন-চারটি মাদুর হাতিয়ে নিয়ে, এ ওকে গালাগালি করে আর আমাদের নিয়ে মহা হাসাহাসি করে তবে ওঁরা শান্ত হলেন। আমরাও গুটি গুটি বাড়ি গিয়ে ডেটল দিয়ে চান করে হাঁপ ছাড়লাম। বন্যায় বেঁচে যাওয়ার অপরাধবোধ নাহয় হাসিঠাট্টার বিষয়। কিন্তু এইরকম এক-একটি এলাকায় হঠাৎ এক সকালে ত্রাতা হয়ে পৌঁছে যাওয়ার হঠকারিতার অপরাধবোধ ভীষণ গোলমেলে।
যাঁরা দুর্যোগের সময় ত্রাণের কাজ করেছেন তাঁরা জানবেন, ত্রাণ লুট হয়ে যায় প্রায়ই। মানুষ সমস্যার মধ্যে থাকলে তাঁদের শরীর ও মেজাজ ভালো থাকে না, যুক্তি বা মানবিকতার কথা ছেঁদো বলে মনে হয়। অচেনা, অজানা আরেক দল মানুষ বাইরে থেকে খাবার-জল-বিছানা-পত্তর নিয়ে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে এগিয়ে আসেন – সেটা ভালো লাগে না। বেঁচে থাকা ভালো, কিন্তু সাহায্য নিতে বাধ্য হওয়া ভালো নয়। ত্রাণ যাঁরা নিয়ে যান তাঁরা অনেক সময় এটাকে সাহায্য বলে ভুল করেন। ত্রাণ যাঁরা নেন, তাঁদের কাছে এটা অধিকার – কোথাও কোথাও হয়তো তাঁরা এটাকে গোষ্ঠীগত অধিকার বলে মনে করতে পারেন, কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এটা একটা ব্যক্তিগত অধিকারের প্রশ্ন হয়ে দাঁড়ায়। তাই বড়মাপের রিলিফের কাজ করতে গেলে পুলিশ টুলিশ নিয়ে যেতে হয়। তারপর ধরুন যেসব জায়গায় ত্রাণ নিয়ে যাবেন, সেখানকার মানুষ তাঁদের দুঃখ-দুর্দশার কথা দশ হাতের জায়গায় বারো হাত করে বলেন। কারণ হয় সেই বারো হাতটাই তখন তাঁদের কাছে সত্যি, অথবা তাঁদের সত্যিকারের সত্যিটা আপনার-আমার জানার অধিকার আছে বলে তাঁরা মনে করেন না, যা ন্যায্য।
এরই আরেক পিঠে রয়েছে তিরুপ্পোরুরে ইরুলাদের আদিবাসী গ্রামগুলি। দলিত গ্রাম – সরকার থেকে তিরিশ বছর আগে তৈরি করে দেওয়া বাড়িঘর বন্যায় ধ্বসে পড়েছে। পরিবারবৃদ্ধির সাথে সাথে আশেপাশে নারকেল পাতার ছাউনি দেওয়া মাটির চালা উঠেছে – সেগুলির অবস্থা আরও শোচনীয়। পেশায় ভাড়া করা কৃষক বা শ্রমিক – কেউ কেউ এমনকি বন্ডেড লেবার হিসেবেও কাজ করেন। বন্যার সময় আশ্রয় পেয়েছিলেন একটি স্কুলবাড়িতে এবং আশেপাশের অপেক্ষাকৃত উঁচু জাতের মানুষের বাড়ির ছাদে! অবশ্য কাডালুরের ভডক্কুতুরাই গ্রামে শুনেছি উঁচু জাতের মানুষেরা দলিত গ্রামবাসীদের তাঁদের গ্রামে ঢুকতেই দেননি পরিষ্কার জলের ভাগ নিতে (এ ঘটনা অবশ্য এই গ্রামে প্রথম নয়; যখনই কোনো দুর্বিপাকে একটি সাধারণ উৎস থেকে জল সংগ্রহের প্রয়োজন হয়েছে, এ গ্রামে দলিতরা চোখরাঙানি থেকে পুলিশি ধরপাকড় সবেরই মুখোমুখি হয়েছেন)। তা সেদিক থেকে দেখলে ইরুলাদের অবস্থা অন্তত একরকমের মন্দের ভালো। যাই হোক, এই অবস্থায় থেকেও তাঁরা – বিশেষত ইরুলা মহিলারা – শান্তভাবে নিয়ম মেনে তাঁদেরই প্রতিনিধিদের সাহায্যে সামান্য টার্পুলিনের শীট আর প্লাস্টিকের দড়ি ভাগাভাগি করে নিলেন। আর যেখান থেকে তাঁরা ত্রাণ বা ত্রাণের আশ্বাস পেয়েছেন তার কথাও জানালেন। এখানে রিলিফের কাজে প্রথম ক’দিন আমি নিজে পৌঁছে উঠতে পারিনি, ছবি দেখেছিলাম। জল তখনও সরেনি, রাস্তা ভাঙা, চালামাত্র সম্বল – এইরকম মনে হয়েছিল। এবারে গিয়ে দেখলাম – স্যানিটারি সিস্টেমের কথা বলতে পারি না, কিন্তু সামনাসামনি – অন্তত দৃশ্যত – তাঁরা তাঁদের ভাঙাচোরা গ্রামগুলিকে কোনো এক স্তরে একরকম গুছিয়ে ফেলতে পেরেছেন। হয়তো তা তাঁরা পেরেছেন কোনো এক অসংজ্ঞাত গোষ্ঠীচেতনা থেকে, নয়তো বা শহুরে দৃশ্যদূষণের আওতার বাইরে থাকার ফলে। আবারও অতিসরলীকরণের ভয় থেকে যায়, তবু ‘সহজ ও স্বচ্ছল জীবনযাত্রা’ কী, ‘পিছিয়ে পড়া’ বা ‘এগিয়ে যাওয়া’ বলতে ঠিক কী বোঝায় – এইসব প্রশ্নগুলি এমন অবস্থায় বারবার মনে পড়ে। তাদের পূর্বনির্ধারিত উত্তরগুলির সত্যতা নিয়ে নতুন করে সন্দেহ তৈরি হয়। তবে দিনের শেষে এ-ও হয়তো সেই লাঙ্গলের ঈষ দেখার মত বা হেলিকপ্টার থেকে বন্যা দেখার মতই কথা হলো।
মিথ্যে কথা
নিত্যানন্দ জয়রামণ যেমন বলেছেন, বছর ঘুরলে পরে, একটি ঘটনা – সে যত মস্ত ঘটনাই হোক না কেন – মোটের উপর গল্পকথা হয়ে দাঁড়ায়। তবে ভিন্ন ভিন্ন মানুষের কাছে ওই একটিই ঘটনা এক-একটি আলাদা গল্প হয়ে ওঠে। কারুর সাথে কারুরই অভিজ্ঞতা বা স্মৃতির আগাপাশতলা মিল নেই। তার মানে কিন্তু এই নয় যে এদের মধ্যে কেউ একজন সত্যি বলছেন, বাকি সবাই মিথ্যে। এই এক চেন্নাইয়ের বন্যার সাথে কতরকমের মিথ্যে জড়িয়ে আছে! রাজনৈতিক নেতাদের ছলচাতুরি বা আশ্বাসবাক্য বা আত্মপ্রচারজনিত মিথ্যে। তারপর ধরুন ইরুলারা তিলকে তাল না বানালেও – আগেই বলেছি – বন্যার্ত মানুষ অনেক কথা বলতে গিয়ে মিথ্যে করে ক্ষয়ক্ষতি বা দারিদ্র্যের কথা বলেন, কি ত্রাণ পেয়েছেন বা পাননি সেসব নিয়ে রঙ চড়িয়ে হা হুতাশ করেন। ওদিকে আমার মত যাঁরা চেন্নাইতে থেকেও বন্যায় তত বিপাকে পড়েন নি, তাঁরা কি ঘাস খাবেন? তাই ফেসবুক-টুইটারে মানুষ ইস্ট কোস্ট রোডের কুমীর প্রকল্প, গিন্ডির সর্পোদ্যান থেকে কুমীর, অজগর সাপ সব পালিয়ে গিয়ে বন্যার জলে ঘাপটি মেরে আছে বলে গল্প ফেঁদেছেন। অনেকে, যাঁরা ভেসে যাবেন এই ভয়ে বাড়ির উপরতলায় বসেছিলেন আর পাশের বস্তির বাচ্চা ছেলেগুলি, যারা নৌকো করে বাড়ি-বাড়ি জল-টল পৌঁছে দিচ্ছিল তারা ‘কি জানি কি মিথ্যে বলে বেশি টাকা নিয়ে নিল’ তাই বলে গজগজ করছিলেন, তাঁরা অনেকে ইন্টারনেট কানেকশন পাবার পর রিলিফের আর্জি শেয়ার করে আপডেট নিতে ভুলে গেছিলেন। তাইতে অনেকে একই এলাকায় একশো প্যাকেট গুঁড়ো দুধ পাঠাবার জায়গায় কয়েকশো পাঠিয়ে ফেলেছেন। এও একধরণের মিথ্যে। একটা সাক্ষাৎকারে মজার গল্প শুনছিলাম যে কোন এলাকায় জানি প্রচুর স্যানিটারি ন্যাপকিন পাঠানো হয়েছে, কিন্তু সেখানে মেয়েদের হয় সব জাঙ্গিয়া ভিজে, নয় সেসব ভেসে গেছে, ফলে সেই ন্যাপকিন মোটেও ব্যবহার করা যায় নি। এইসব আরও কত কি! আবার ধরুন এই এক বন্যায় মানুষ কত ভাবে মরতে পারেন – তার নানা গল্প। এক বৃদ্ধ আর্মি অফিসার তাঁর নিজের বাড়িতে ন-ঘন্টা ধরে চিৎকার করেছেন বেরিয়ে আসতে পারছেন না বলে – ঠিক যেন টাইটানিকের মত করুণ – শুনলে পট করে চোখে জল চলে আসে। আবার আরেক দিকে শুনছি জনাতিনেক ছেলের নাকি সেলফি তুলতে গিয়ে পিছলে জলে পড়ে পঞ্চত্বপ্রাপ্তি ঘটেছে – শুনে মুখ টিপে হেসে মরি আর কি! বন্যার জল সরে যাওয়ার পর শুকনো বিছানায় শুয়ে এসব গল্পের শিকড় যাচাই করতে যাওয়ার প্রয়োজন কি? এসবই সত্যিমিথ্যে মিলিয়ে মানুষের বেঁচে থাকার আর মরে যাওয়ার ব্যক্তিগত গল্প। চেন্নাইয়ের বন্যা শুধু আরেকটি নতুন পরিপ্রেক্ষিত তৈরি করে দিল।