(দুর্বার, ডিসেম্বর ২০১৭)
দেবদাসী বিতর্ক
কোনো এক দিকে এক পা ফেলে এগোনোকে আরেক দিক থেকে দেখলে আবার এক পা পিছোনো বলে ঠাহর হতে পারে, সে যতই ঢাকঢোল পিটিয়ে ফেলা পা হোক না কেন। প্রাক-ঔপনিবেশিক যুগ থেকেই তামিলনাড়ুর শহরে-গ্রামে, রাজার বাড়ি থেকে মন্দিরে, স্থানীয় ধর্মীয় অনুষ্ঠান থেকে গ্রাম্য পালাপরবে, বড়-ছোট নানান সভায় হাজির ছিল ‘সাদির’ নাচ, যা এক বিশেষ সম্প্রদায়ের দেবদাসীরা নাচতেন। তাকে অশ্লীলতা দোষে নিষিদ্ধ ঘোষণা করার পাশাপাশি, মোটামুটি তিরিশের দশক থেকে তার পুরোদস্তুর সংস্কৃতায়ন ঘটিয়ে আজকের দিনের ভরতনাট্যমের অভিষেক হয়। এই ঘটনাকে অনেকেই ভারতীয় নারীর এক ধরনের ক্ষমতায়ন, এক বিশেষ ভারতীয় সংস্কৃতির জয় বলে দেখেছিলেন। তাঁদের কাছে ১৯৪৭ সালে পাশ হওয়া ‘প্রিভেনশন অফ ডেডিকেশন অ্যাক্ট’, যা দিয়ে তামিলনাড়ুতে দেবদাসী প্রথা আর তার সাথে পেশা হিসেবে সাদির নাচকে সম্পূর্ণ বেআইনি ঘোষণা করা হয়, এবং এই নাচকে নানা নতুন নিয়মে সাজিয়ে ভরতনাট্যমে রূপান্তরিতকরণের পথটি ছিল একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার মুখোশ খুলে দেওয়ারই নামান্তর।
এই অ্যাক্ট যাঁদের হাতে তৈরি, তাঁরা ঘোষিত ভাবে চেয়েছিলেন, নারীদের ‘দেভরাডিয়ার’ (তামিলনাড়ুর মন্দিরে দেবতার কাছে সমর্পিত যে নারী) থেকে ‘থেভডিয়া’ (যৌনকর্মী) হয়ে ওঠার রাস্তাটি দমন করতে। অথচ অনেকের কাছে আবার এই দমন পদ্ধতিটি নিজেই হয়ে ওঠে এক শোষণমূলক সিদ্ধান্ত, যা নর্তকীর শরীরের একটি স্বাভাবিক সহজাত গতিবোধকে অনৈতিক, অশিক্ষিত বা বেনিয়মী নাম দেয়। অথচ ক্রমশ দেখা যায়, নাচের এবং নর্তকীর চরিত্রের ভালোমন্দ বিচারের উপর চাপিয়ে দেওয়া এই নয়া সংস্কারও ঘুরিয়েফিরিয়ে আবারও নর্তকীর শরীরকে একটি ‘বস্তু’ হিসেবেই ব্যবহার করতে থাকে – খালি এই বস্তর মালিকানা রাজারাজড়া বা পুরোহিত সম্প্রদায়ের হাত থেকে উঁচু মহলের ‘উঁচু জাতের’ – মূলত ব্যবসায়ী শ্রেণির হাতে গিয়ে পড়তে থাকে। সমসাময়িক অর্থনীতির নিয়ম অনুযায়ী তেমনটিই হবার কথা ছিল। কিন্তু স্বাভাবিক ভাবেই প্রশ্ন ওঠে, তবে কি সংস্কার শুধুমাত্র শুধু সেই নৃত্যরূপ বস্তু কার ভোগে লাগবে – তাই নিয়ে? নাচের, বা নর্তকীর বস্তুকরণ নিয়ে নয়? খেয়াল করলে দেখা যাবে, যে এই আইনি ঘোরপ্যাঁচ প্রবর্তনের সাথে তাল মিলিয়েই হয়েছিল ভরতনাট্যমের ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী সংস্কৃতায়নেরও সূচনা, যার মাধ্যমে সাদির-কে অন্যান্য লোকনৃত্য, গণনৃত্য, গণনাট্য ইত্যাদি থেকে দূরে সরিয়ে আনা হতে থাকে। এই দূরে সরিয়ে আনার পদ্ধতিটি আজ মোটের উপর সম্পূর্ণ হয়েছে। ভরতনাট্যম-কে তামিলনাড়ুতে আজ অনেকেই জাত এবং শ্রেণির হিসেবে সমাজের উপরতলার সাথে এক করে দেখেন – সঙ্গত কারণেই। এটা ছিল ঐ সংস্কারের একটা দিক।
আবার কারুর কারুর কাছে এই সংস্কারের আরেকটা দিক ছিল আসলে এক শ্রেণি পরিবর্তনের সূচনা, যার ভিতর দিয়ে এই শিল্পীরা – অর্থাৎ দেবদাসীরা – সামন্ততন্ত্রী ক্ষমতাকেন্দ্রের পৃষ্ঠপোষকতা হারিয়ে ভূমিহীন কৃষক বা শ্রমিকের জীবন-সংগ্রামে নামতে বাধ্য হন। “নাচিয়ে মেয়ে থেকে শ্রমজীবী মহিলা” – গবেষক বিজয়া রামস্বামী এইভাবে বিষয়টিকে বর্ণনা করেছেন। অবশ্য দেবদাসী সম্প্রদায়ের, বা আরও সাধারণ ভাবে বলতে গেলে তাঁরা যে ‘ইসাই ভেল্লালার’ সম্প্রদায়ের অংশ, তাঁদের শ্রেণি-পরিচয়, যা আবার তাঁদের জাতিবর্ণ-পরিচয়ের সাথে অঙ্গাঙ্গী ভাবে যুক্ত, ঐতিহাসিক ভাবে এতবার এতরকম পরিবর্তনের মধ্যে দিয়ে গেছে, যে তাই নিয়ে যথাযথ আলোচনা করতে গেলে আমরা আর এই স্বল্প পরিসরে তামিলনাড়ুর পুদুক্কোট্টাই জেলার ভিরাইমালাইবাসিনী মুত্থুক্কান্নাম্মলের বাড়ি পৌঁছে উঠতে পারবো না!
প্রিভেনশন অ্যাক্ট চালু হবার আগে থাকতেই রুক্মিণী দেবী অরুন্ডেলের হাত ধরে ম্যাড্রাস শহরে ‘কলাক্ষেত্র স্টাইলে’ যে ভরতনাট্যমের প্রতিষ্ঠা, বিশ্বের কাছে তার অন্যতম দোহাই ছিল নাচের বাণিজ্যিকরণের প্রতিবাদ। অর্থাৎ সাদির হল বাণিজ্যিকৃত নাচ, আর ভরতনাট্যম হল উঁচু জাতের শিল্প – যাতে টাকাপয়সার নামগন্ধ নেই – আছে শুধু সৃষ্টির আনন্দ আর সেই আনন্দের পথে কঠোর নিয়মানুবর্তিতা। অথচ আজ সেই সাদিরকন্যা ভরতনাট্যম (এই নিয়ে যদিও মতপার্থক্য রয়েছে) আজ সামাজিক-অর্থনৈতিক ভাবে এতটাই ছড়িয়ে গেছে, যে তাকে ‘শিল্প’ অর্থে ধরতে গেলে ‘সৃষ্টিশীলতা’র বিচারে না দেখে ‘ইন্ডাস্ট্রি’ অর্থে দেখাই ভালো। খালি তামিলনাড়ুতে নয়, এদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে – এমনকি বিদেশেও – এই ভরতনাট্যম ইন্ডাস্ট্রি চাকরির বাজারে পর্যন্ত অবদান রাখতে পেরেছে, আর তা শুধু নাচের অনুষ্ঠান বা শিক্ষার ভিতর দিয়ে নয়, গবেষণা, সাংস্কৃতিক আদানপ্রদান, সিনেমা ইন্ডাস্ট্রি – ইত্যাদি নানা দিক থেকে। মজার কথা হল, রুক্মিণী দেবীর কলাক্ষেত্র ফাউন্ডেশন-এর অবদান এ বাবদে কিছু কম নয়। আসলে সাদির যেভাবে তামিলনাড়ুর গণ্ডি ছাড়িয়ে এ দেশের নানা রাজসভায় ছড়িয়ে পড়েছিল রাজনৈতিক আর সাংস্কৃতিক আদানপ্রদানের ভিতর দিয়ে, এ-ও তেমনই। যদিও এই ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী সময়ে ভরতনাট্যমের যে বাড়বাড়ন্ত, তাতে স্বাভাবিক ভাবেই অধিকাংশ (নিষিদ্ধ) দেবদাসী বা তাঁদের পরিবারের বিশেষ কোনো উপকার হয়নি।
এই সাদির থেকে ভরতনাট্যমে পৌঁছনোর জটিল গল্পটিকে আমরা তাহলে কি ভাবে দেখব? এর উত্তর সরাসরি হ্যাঁ-না-য় দেওয়া মুশকিল। সাধে কি প্রায় এক শতাব্দী ধরে এই দেবদাসী বিতর্ক জারি রয়েছে!
ক্ষমতা লুপ্তি
তবে আমরা এটুকু নিঃসন্দেহে বলতে পারি যে, নট-নটী-‘নট্টুভনার’ মিলিয়ে ইসাই ভেল্লালার সম্প্রদায়ের ভিতরে এই একদল শিল্পী ছিলেন বহু প্রজন্ম ধরে, যাঁদের কাছে জীবন আর শিল্প ছিল প্রায় সমার্থক। তাঁরা শিক্ষানবীশ হিসেবে দিনরাত তালিমের মধ্যে দিয়ে যেতেন এবং তাঁদের শিল্প প্রদর্শনের জন্য আজকালকার শিল্পীদের মতো হ্যা-হ্যা করে ঘুরতে হত না। মোটামুটি নিরাপদ এবং শক্তিশালী পৃষ্ঠপোষকতার প’য়ে তাঁরা নিজেরাও খানিক খানিক ক্ষমতার অধিকারী হয়ে দাঁড়াতেন – জমি, অর্থ এবং সম্মানের ভিতর দিয়ে। তবে বড়লোক মুনিব হলেও এই শিল্পীরা সাধারণত সব শ্রেণির মানুষের সামনেই অকাতরে নাচগান-বিনোদন করে থাকতেন। এমনকি তাঁদের গানের কথায়, চলাবলার ধরনে প্রায়ই দেখা যেত ঐ উঁচতলার মানুষগুলি এবং তাদের নিয়মকানুনের প্রতি একরকমের ব্যঙ্গ। শুধু নাচগানের ভিতর দিয়ে নয়, রোজকার জীবনেও এটি ফুটে উঠত। বিশেষত মহিলারা, যাঁরা মূলত দেবদাসী হতেন – দেখা যেত এই শৈল্পিক জীবন তাঁদের হাতে এক মাতৃতান্ত্রিক জীবনযাপনের চাবিকাঠি তুলে দিচ্ছে – যেখানে বিয়ে, সন্তান, সম্পত্তির অধিকার – এইসমস্ত বিষয়ে বাকি সমাজের সাথে তাঁরা ঘোষিত ভাবেই ভিন্ন মতে চলতেন; হয়তো শিল্পের ভিতর দিয়ে মানুষ মাঝেমাঝে যে স্বকীয়তা, স্বনির্ভরতা খুঁজে পায় – খানিকটা তা-ও এর সাথে হাত মিলিয়েছিল।
যে দেবদাসীদের মতামত পরবর্তীকালে সংকলিত হয়েছে, কিম্বা ডঃ মুত্থুলক্ষ্মী রেড্ডি-প্রণীত প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এর প্রতিবাদে দেবদাসীদের প্রতিবাদ যে মিছিল এবং পিটিশনের আকারে বেরিয়ে এসেছিল, তার বিবরণ থেকে স্পষ্টই মনে হয় যে, এই সম্প্রদায়ের বহু শিল্পীই নিজেদেরকে এই শোষণ-প্রথার শিকার হিসেবে দেখতেন না – যতই প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এর পিটিশনে তেমনটি দাবি করা হোক। তার সাথে সাথে এটাও পরিষ্কার বোঝা যায়, যে তাঁরা তাঁদের শিল্পের অন্তঃসারটিকে “কুরুচির ফসল এবং ব্যবসাদারি” বলেও মনে করতেন না – যেমন কলাক্ষেত্র-র প্রতিষ্ঠাত্রী রুক্মিণী দেবী দেবদাসীদের নাচ সম্পর্কে বলেছিলেন। আসলে শিল্পকলায় রুচির বিচার শ্রেণি-জাতি-লিঙ্গবিশেষে প্রায়ই জটিল আর আপেক্ষিক হয়ে দাঁড়ায়। আর এই ক্ষেত্রে ব্যবসাদারির কথায় আসতে গেলে, সার্বজনীন আর ব্যক্তিগত খাতে চলতি বিনোদন শিল্প, তার মধ্যে শিল্পকলার – আবার একই সাথে যৌনতার – কি ভূমিকা, তাদেরকে ‘শ্রম’ হিসেবে দেখা যায় কিনা, তাই নিয়ে বিস্তর ভাবনাচিন্তা করার দরকার হয়ে পড়ে। এই বিষয় নিয়ে নানা ক্ষেত্রে নানা আলোচনা-বিতর্ক হয়েছে এবং হয়ে চলেছে। তবে সেসব বাদ রেখেও এইটুকু বলাই যায়, যে এই প্রিভেনশন অ্যাক্ট ছিল যেন উপর থেকে চাপিয়ে দেওয়া নিয়ম, তলা থেকে শক্তি জোগান দেওয়া নয়। শ্রেণিচিন্তাহীন, বর্ণচিন্তাহীন এক অসম্পূর্ণ প্রয়াস, যাতে কোনোরকমের পুনর্বাসনেরও কোনো অবকাশ তৈরি করার বিশেষ একটা চেষ্টা দেখা যায়নি। সাদির শিল্পটিকে এক অন্য সমাজে, তার সামন্ততান্ত্রিক, পিতৃতান্ত্রিক শোষণ থেকে বার করে এনে, অথচ তাকে ব্রাহ্মণ্যবাদী শিকলে না বেঁধে, তার লোকশিল্পের ধরনটি বজায় রেখে, অন্য কোনোভাবে ব্যবহার করা যায় কিনা, তা নিয়ে সেসময় না নিয়মনবীশরা, না সমাজকর্মীরা খুব একটা চিন্তাভাবনা চিন্তাভাবনা করেছিলেন।
একটি অন্য দেশের উদাহরণ মনে পড়ে যায় এই প্রসঙ্গে। ১৯৪৯-এ চীনা বিপ্লবের পরে পরেই বেজিং-এর ব্রথেলগুলিতে কম্যুনিস্ট পার্টি থেকে ব্যবসা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেবার আইন জারি হয়ে যায়। অথচ যৌনকর্মীরা তাঁদের ইচ্ছেমত কম্যুনিস্ট পার্টির কর্মী – বিশেষত সাংস্কৃতিক কর্মী – হিসেবে কাজ বেছে নেবার সুযোগ পান। তাঁরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে সামন্ততান্ত্রিক-পিতৃতান্ত্রিক অত্যাচার-শোষণের বিরুদ্ধে জেগে উঠবার কাহিনী নিয়ে নানারকম ‘পারফর্মেন্স’ করতে থাকেন। সাদির নিয়ে কি এইরকম কিছু ভাবা যেত? তাকে কি সেই সময়কার যে জাতিবর্ণবিরোধী ব্যাপক আন্দোলন চলছিলো তামিলনাড়ুতে, তাতে সামিল করে নেওয়া যেত? এ নিয়ে কোনো আলোচনার ইতিহাস খুঁজে পাওয়া যায় না।
তবে যে সব দেবদাসীরা নিজেরা অপেক্ষাকৃত উঁচু শ্রেণি এবং জাতিবর্ণ থেকে এসেছিলেন, তাঁদের কেউ কেউ কিন্তু শহুরে সমশ্রেণি-সমজাতিবর্ণের শিল্পরসিকদের আসরে নাম করে নিতে পেরেছিলেন এবং পরবর্তীকালে ব্রাহ্মণ্য শিল্পসংস্কৃতির জগতেও প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিলেন (যেমন ভরতনাট্যম, কর্ণাটকী সঙ্গীত ইত্যাদি)। ঔপনিবেশিকতা-পরবর্তী যুগে ক্রমশ ম্যাড্রাস শহরই হয়ে ওঠে শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে খ্যাতি এবং অর্থের মূল ভাণ্ডার। অন্যদিকে যে দেবদাসীরা তথাকথিত নিম্ন শ্রেণি আর জাতিবর্ণ থেকে আসেন এবং গ্রামাঞ্চলের বাইরে এসে নতুন ‘কেরিয়র’ গড়ে তলা যাঁদের সাধ্যে ছিল না, তাঁদের ভাগ্যে জুটেছিল শুধুই ঐ প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এর খবরদারি, তাঁদের জীবনধারণের পরিচিত পথটির অবলুপ্তি এবং সাথে সাথে নানা স্তরে ক্ষমতা লোপ। বর্তমানে আশির উপরে বয়েস যে দেভরাডিয়ার মুত্থুক্কান্নাম্মলের, তাঁর কাহিনীও এইরকমই।
ভিরালিমালাই মুত্থুক্কান্নাম্মলের জাদু-বাক্স
“আমার বছর তিরিশেক বয়েস থেকে সেই যে নাচ ছেড়েছি, তখন থেকে এই গানগুলো আমি নিজের জন্যেই গেয়ে আসছি। মাঝে মাঝে মনে হয়, ‘কেনই বা আর!’আসলে তোমার হয়তো মনে হচ্ছে যে আমার সব হারিয়ে গেছে, আর এই গানগুলোরও আর লোকের কাছে কোন মূল্য নেই। কিন্তু আমার কাছে আছে, এরা আমারই একটা অংশ। তাই আমার গানও আর থামতে চায় না।” – বলছেন মুত্থুক্কান্নাম্মল গবেষক দভেশ সোনাজিকে। প্রিভেনশ অ্যাক্ট-পূর্ববর্তী যে কয়েকজন হাতে গোনা দেবদাসীর খবর পাওয়া গেছে তামিলনাড়ুতে গত কয়েক বছর অব্দি, মুত্থুক্কান্নাম্মল তাঁদের মধ্যে একজন। নৃত্যশিল্পী অখিলা এবং সাংস্কৃতিক গবেষক গান্ধী রাজনের সঙ্গে (যিনি এই সাদির শিল্পীর সাথে গত এক দশক ধরে যোগাযোগ রেখে চলেছেন) মুত্থুক্কান্নাম্মলের সাথে দেখা করতে গিয়েই এই লেখা বিষয়ে উৎসাহ পাই আমি – নিজে একজন নৃত্যশিল্পী এবং নাচের – বিশেষত ভরতনাট্যমের – দর্শক হিসেবে।
ত্রিচির কাছে ভিরালিমালাই শহরতলিতে কয়েক প্রজন্ম ধরে নৃত্যগীত বিশারদ এক স্বচ্ছল পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রায় ১৯৫০ সাল পর্যন্ত এই পরিবারের শিল্পীরা শুধু ওখানকার মুরুগন মন্দিরেই না, নিকটবর্তী পুদুকোট্টাই শহরের বড় শিব মন্দিরেও নিয়মিত গানবাজনা-দেববন্দনা করতেন। মুত্থুক্কান্নাম্মলকে তাঁর সাত বছর বয়েসে ‘দেভরাডিয়ার’ হিসেবে উৎসর্গ করা হয়। তিনি তাঁর বাবা ছাড়াও দিদিমাদের কাছে, পিসিদের কাছে নাচতে শেখেন। বাবা প্রখ্যাত ‘নট্টুভনার’ রামচন্দ্র, দিদিমা দেবদাসী নাগাম্মল, তুতো-দিদিমা দেবদাসী আম্মানি – এরা ছিলেন ঐ অঞ্চলের বিখ্যাত শিল্পী। এঁদের নাচের শিক্ষা ছিল তাঞ্জাভুর স্টাইলে। তখনকার নিয়ম মত এঁরা নাচের সাথে সাথে গানও গাইতেন একইসাথে, যা আধুনিক কালে শাস্ত্রীয় নাচ থেকে একেবারেই উঠে গেছে।
মুত্থুক্কান্নাম্মল বড় হয়ে উঠবার সাথে সাথে, মন্দিরে-রাজসভায়-লোকশিল্পসভায় নাচতে-নাচতে গাইতে-গাইতেই তাঁর ছোটবেলার স্বচ্ছল সমৃদ্ধ পরিবারটিকে বদলে যেতে দেখতে থাকেন। মন্দির থেকে, রাজবাড়ি থেকে আসা অনুদানের স্রোত শুকিয়ে যেতে থাকে। দভেশ সোনাজির সাথে তাঁর দীর্ঘ সাক্ষাৎকার সোনাজির অন্ধ্রপ্রদেশী দেবদাসীদের নেওয়া সাক্ষাৎকারের সাথেও মিলে যায়, যেখানে সোনাজি লেখেন – “আজ আর কোন দর্শকমণ্ডলী নেই, কিন্তু তাদের থাকা না থাকা আজ আর শিল্পনির্মাণের ভিত্তিও নয়। দেবদাসী মেলা [অন্ধ্রের বৈশিষ্ট্য] বলতে আজ তাঁদের অন্তরজগতটুকুই। সার্বজনীন নৃত্যজগত থেকে তাঁরা তাঁদের স্মৃতির জগতের বাসিন্দা হয়ে পড়েছেন।”
সোনাজি তাঁর ‘আনফিনিশড জেসচার’ [অসমাপ্ত মুদ্রা] বইতে লিখেছেন, মুত্থুক্কান্নাম্মলের নাচকে বিষয় আর ধরনের হিসেবে তিন ভাগে ভাগ করা যায় – তাঞ্জাভুর স্টাইলে রাজসভায় রাজবন্দনা, মন্দিরে দেববন্দনা এবং সার্বজনীন মুক্তসভায় বিনোদনমূলক ‘রসের গান’ – প্রেম বা হাসিঠাট্টা তার বিষয়। গানগুলির কথা খুবই মনোহারি – দক্ষিণ ভারতের গানের জগতে এই বিশেষ গানগুলি আর শোনা যায় না, কোনো কোনো গানের কথায়-সুরে আবার কর্ণাটকী গানে বৈদেশিক প্রভাবের বিষয়টি ছুঁয়ে যায়। হরেক রকমের গান – সাহসী, বেপরোয়া, মজার, পিছনে লাগার, দুঃখের, বিষাদের… ধর্মীয় গানগুলিতে ধর্ম রয়েছে বটে, কিন্তু তাদের মধ্যে দিয়ে দেবতাকে দেখার ধরনটি অনেকটা বাউল-সূফী গানের ধাঁচে – যেন দেবতা গায়িকার ঘরের মানুষ। এই ধাঁচটি অবশ্য বহু লোকগীতিতেই উপস্থিত – বিশেষ করে যখনই সেই লোকগীতি উঁচু মহলের ধর্মের ধরনধারণ নিয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিতে চেয়েছে।
মুত্থুক্কান্নাম্মলের সব গানের সাথে সাথে মুখভঙ্গী বা হস্তভঙ্গী কিন্তু আগে থাকতে মুখস্থ করে রাখা নয় – যেমন আজকের দিনে করা হয়। সেদিক থেকে দেখলে মনে হয়, তাঁদের সময়ে নাচ আর নাটক – এই দুটি শিল্পকে হয়তো তত আলাদা ভাবে দেখা হতো না। সাদিরের রূপ এবং বিষয়ের মূল লক্ষ্যটি থাকতো নর্তকীর নিজস্ব চরিত্রটিকে তাঁর অভিনীত চরিত্রের সাথে আষ্টেপৃষ্ঠে মিশিয়ে ফেলা – যাতে কেউ কাউকে ছাপিয়ে না যায়, নিছক বিষয়ের লেজ-ধরা চরিত্রায়ন নয়। এটি আজকের ‘পারফর্মেন্স আর্ট’-এর জগতে আজও সমান প্রাসঙ্গিক একটি বিষয়।
কেমন ছিল মুত্থুক্কান্নাম্মলের প্রাপ্তবয়স্ক জীবন? তাঁর ও তাঁর পরিবারের পৃষ্ঠপোষকের সংখ্যা ক্রমশ শূন্যে এসে ঠেকে, অনুদান পাওয়া জমি হাতবদল হতে থাকে, যে মন্দিরে তিনি বছরের পর বছর নেচেছেন, সেখানে তাঁর ঢোকাটাই একটি বিতর্কের বিষয় হয়ে দাঁড়াতে থাকে, যাকে তিনি শিল্প বলে জেনেছেন তা তার পূর্বাধিকার হারাতে থাকে, লোকে আর তা দেখে টাকাপয়সা ঠেকাতে চায় না, ভুলে যায় যে এমন নাচও হত একসময়। তবু বোঝা যায় যে এসব সত্ত্বেও তিনি হেরে যাননি। এটা ঠিক ‘জীবনের উপর শিল্পের জয়’ গোছের রোমাঞ্চকর গল্প নয় – অনেক আটপৌরে। একজন মানুষের ভিতরকার শিল্পী, কীভাবে তিনি এক গড়পড়তা ঘরোয়া জীবন বেছে নেবার পরেও, প্রায় একা-একাই বেঁচে থাকে। হয়তো তার সবচাইতে বড় প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ওঠে উপভোক্তার অভাব, গুণগ্রাহিতার অভাব। সেই গুণগ্রাহিতা, যা একজন শিল্পীর সৃজনশীলতার পিছনে ধুনকি দেওয়া ‘অ্যাড্রিনালিন’ নামের নেশাটির বাহক। মুত্থুক্কান্নাম্মল আসলে সেইসব দেবদাসীদের প্রতিনিধি, যাঁদের জীবন প্রিভেনশন অ্যাক্ট-এর প্যাঁচে পরে কেমন যেন দড়কচা মেরে গিয়েছিল। না তাঁরা সাংস্কৃতিক জগতের তারা হয়ে ফুটে উঠতে পেরেছিলেন, না-ই তাঁদের হতে হয়েছিল পেশাগত যৌনকর্মী বা অতিদারিদ্র্যের শিকার – মাঝামাঝি ঝুলে ছিলেন। অথচ একজন প্রায়-স্বামীবিহীন, একা হাতে দুই ছেলেকে সামলানো, অধুনা শ্রমজীবী পরিবারের কর্ত্রী মুত্থুক্কান্নাম্মল আজও নাচ নিয়ে, নর্তকীর শরীর নিয়ে ভাবছেন, নিজের মতো করে তাদের সংজ্ঞায়িত করছেন।
তাঁর জাদু-বাক্সের সবচাইতে মজার জিনিসটি হল তাঁর শিল্প কীভাবে তাঁর কথাবার্তায়, চলাবলায় চুঁইয়ে পড়ে – তাই দেখা। তাঁর এই শিল্প, জীবনদর্শন কোনো মহান দার্শনিক গভীরতার প্রতীক নয়, বিশেষ একটা প্রগতিশীলতার প্রতীকও নয়। কিন্তু তার শরীরায়নে রয়েছে খেলাচ্ছলে এক সূক্ষ্ম বিদ্রোহের ভাব – যা আধুনিক নাচে অব্দি বড় একটা দেখা যায় না। এ যেন প্রাত্যাহিকতার ভিতর যে নানা ছোট ছোট বিদ্রোহের ছবি ফুটে থাকে, যার কোন স্থান থাকে না বড় মাপের সামাজিক বিপ্লবে, তাদেরই মতো। এই খেলাচ্ছলে বিদ্রোহের ভাবটি একবার দেখতে পেলে তখন কল্পনা করতে ইচ্ছে হয়, যদি সেই সময়কার সামাজিক সংস্কারকদের আরেকটু দূরদর্শিতা থাকত, তবে সাদির কত কি হয়ে উঠতে পারতো!
কুরাভঞ্জির গান
এখনই যে সাদির গানে খেলাচ্ছলে বিদ্রোহের কথা বললাম, তা সরাসরি বা ঘুরিয়েপেঁচিয়ে তথাকথিত নীচু শ্রেণির বা নীচু জাতিবর্ণের মানুষের – বিশেষ করে মেয়েদের – ক্ষমতায়নের কথা বলে। কিন্তু বলার ধরনটি সবসময়ই একটু রঙ্গরস ঘেঁষা, হয়তো যাতে গান শুনে উচ্চশ্রেণি-বর্ণের পৃষ্ঠপোষকদের মনে না হয় যে তাঁদের কড়া ধরনের ব্যঙ্গ করা হচ্ছে। ইসাই ভেল্লালার গোষ্ঠীর পরিচয় আবার ছিল শূদ্রবর্ণ বলেই। কিন্তু তারই মধ্যে তাঁরা অনেক বেশি অধিকার ভোগ করতেন – যেহেতু তাঁদের কর্মপরিচয় ছিল সাংস্কৃতিক – রাজা, জমিদার এবং পুরোহিত শ্রেণির কাছ ঘেঁষাও বটে।
যাই হোক, মুত্থুক্কান্নাম্মলের গানের মধ্যে এই বিষয়টির সবচাইতে ভালো উদাহরণ হয়তো ‘কুরাভঞ্জির গান’, যা আমি খুব সহজে ভুলতে পারবো বলে মনে হয় না। কুরাভঞ্জি হলেন কুরাভর উপজাতির মেয়েরা। তামিলনাড়ুর কুরাঞ্জি পাহাড়ে বসবাস করতেন এঁরা, দেবতা মুরুগনের ভক্ত। এঁদের জাতিবর্ণ-পরিচয়ের সাথে ‘অপরাধী জাত’ ছাপ্পা মারা রয়েছে সেই ব্রিটিশ আমল থেকে, আজও। খেয়াল করার মতো বিষয় হল, আধুনিক শাস্ত্রীয় নাচে কিন্তু এই ধরনের মানুষদের জীবনের কথা কখনোই উঠে আসতে দেখা যায় না।
এই গানটি মুত্থুক্কান্নাম্মল শিখেছিলেন তাঁর বাবার কাছে। গানের সুরটি শুনতে শুনতে পাহাড়ের গা বেয়ে গা দুলিয়ে পাথর ডিঙিয়ে নামতে থাকা কুরাভঞ্জির ছবিটি বেশ স্পষ্ট দেখতে পাওয়া যায়।
আসছি গো, আমি কুরাভঞ্জি আসছি…
যাদের গাঁওদেবতা স্বামী সুব্রমনিয়াম, সেই আমি, আসছি।
আমাদের জাতের কথা শোনো –
আমরা পায়ের আঙ্গুলে চুটকি বাজাই না,
আমরা বিছানাবালিশের হাঙ্গামা করি না,
এ ওকে জড়িয়ে ধরে শুয়েই আমাদের রাত কাবার,
পেট পুরে কাঁজি আর মদ গিলে আমরা নাচি, গাই,
বিল্লিশূন্যম [লেবু ব্যবহার করে একধরনের বাণ মারা] বাঁধতে জানি,
কুরাভর জাতের লোক না হলে সেই বিল্লিশূন্যম কাটতে পারে – এমন সাধ্য কার!
ঈগল পুষি, আমরা মশা পুষি,
তাদের সাথে খেলাধুলো করি সবাই মিলে,
যে বুড়ি মাগীর কোল ভরেনি, কোমর বাঁকা,
তার কোল ভরে দিই আমরা, তার ছুঁড়ির মতো মাই বানিয়ে দিই,
তারপর আসি সেই বাচ্চার সাথে খেলতে,
বোবাকে জানি কথা বলাতে,
আমাদের চুলের গোছায় পাহাড় বেঁধে হ্যাঁচকা টানে পাহাড় দিতে পারি ধ্বসিয়ে…
বিস্মৃতির জগতে ডুব
ইতিহাস আর সংস্কৃতি অতীতকে ধরে রাখে। সেই অতীতকে ঘুরিয়েফিরিয়ে দেখে আমরা বর্তমানকে প্রশ্ন করতে শিখি, ভবিষ্যৎ সৃষ্টি করতেও শিখি। অথচ কোনো কোনো সংস্কৃতি, কোনো কোনো ইতিহাস অন্য অন্য সংস্কৃতি বা ইতিহাসের চাইতে বেশি শক্তিশালী হয়ে ওঠে – আমরা তখন চোখ বুজে বিনা বাক্যব্যায়ে তাকেই সত্যি বলে ভাবতে শিখি। বাকি সব গল্প অমনোনীত স্মৃতি হয়ে ছাইচাপা পড়ে থাকে।
একজন সৃজনশীল শিল্পী তাঁর কাজকে নিছক সৌন্দর্যময়তার আরাধনা বলে দেখতেই পারেন। কিন্তু তার সাথে সাথে তাঁর নাচের ভিতর কেমন যেন এক ভাসা ভাসা ভাব এসে পড়ে – যেন তার কোন ইতিহাসের গভীরে নোঙ্গর বাঁধা নেই, কোনো প্রাচীন সংস্কৃতির সাথে আনুভূতিক গাঁটছড়া নেই। এক রাজনৈতিক বোধের অভাব, অতিরিক্ত ব্যক্তিপ্রাধান্য এই ভাসা ভাসা ভাবের কারণ বলে মনে হয়। শিল্পে অরাজনৈতিকতা আর ব্যক্তিপ্রাধান্যের সম্ভাবনা, শিল্পকে সার্বজনীনতার আওতা থেকে বার করে ব্যক্তিগত সম্পদে রূপান্তরিত করার যে আধুনিক পদ্ধতিটি, তার মধ্যেই যথেষ্ট পরিমাণে রয়েছে (যেমন লোকশিল্পকে প্রেক্ষাগৃহে বেঁধে ফেলা – টিকিট কাটা দর্শকমণ্ডলীর জন্য)। এর উপরে নাচ যদি শুধুমাত্র সেই ব্যক্তিপ্রাধান্যের রাস্তাতেই হাঁটতে থাকে, তার নিজের ইতিহাসকে প্রশ্ন না করে, ছাইচাপা ইতিহাসগুলোকে তুলে আনার চেষ্টা না করে, তাহলে তার নতুন ভবিষ্যৎ তৈরির সম্ভাবনাই বা কোথায়?
তাছাড়া ভেবে দেখতে গেলে, আমরা সেই দেবদাসী যুগ থেকে কতটাই বা সরে আসতে পেরেছি? কোন নাচটি নৈতিক, কোন মুদ্রাটি কুরুচিপূর্ণ, নর্তকীর শরীরের বস্তুকরণ কীভাবে হয়, নাচ মানুষকে কী দেয় – এইসব প্রশ্ন আজও ভারতীয় নাচের জগতে পুরোমাত্রায় বহু বিতর্ক নিয়ে রয়ে গেছে। বিশেষ করে সাংস্কৃতিক ক্ষেত্রে নাচ আর ব্যবসাদারির সহাবস্থান-বিষয়ক প্রশ্নগুলি নিয়েও দীর্ঘ আলোচনা হতে পারে। ভারতীয় শাস্ত্রীয় নাচ আজও অনেকটাই চলে পৃষ্ঠপোষকতার উপরে – অনুদানের মধ্যে দিয়ে – তারও রয়েছে নিজস্ব জটিল রাজনীতি। নাচকে সার্বজনীনতার আওতায় রাখতে গেলে তার সঙ্গত করতে আজকের দিনের কুরাভঞ্জির গান খুঁজে পাওয়া দরকার। মুত্থুক্কান্নাম্মলের গান কি আমাদের ব্যক্তিগত সম্পদমুখী চিন্তাধারাকে ভেঙে একটু অন্যরকম ভাবে ভাবতে শেখায়? হয়তো।
পুনরুজ্জীবনের রাজনীতি
আমাদের ইন্টারনেট-ময় জগতে মুত্থুক্কান্নাম্মলদের মত নাম হয়তো আগেকার দিনের মতো একেবারে চাপা পড়ে যায় না। একবার যখন তাঁদের বাগে পাওয়া যায়, তাঁরা মাঝেমধ্যেই ‘ওয়র্কশপ নিতে’, কিম্বা তথ্যচিত্রে অভিনয় করতে ডাক পান। তাঁরা ক্রমশ গবেষণা আর দেবদাসী ‘থীম’-এর নানা নাচের অনুষ্ঠানের বিষয় হয়ে উঠতে থাকেন।
তার উপরে দেবদাসী-বিতর্কে নৈতিকতা এবং রুচির প্রশ্নটিও আজ খানিকটা ঠাঁই বদল করেছে। যদিও এটা অস্বীকার করার উপায় নেই যে দেবদাসী প্রথা আজও তামিলনাড়ুতে এবং অন্যত্র বেশ শোষণমূলক ভাবেই চালু রয়েছে, এও আবার এক কথায় স্বীকার করে নেওয়া যায় না যে সাদিরের ইতিহাস সেই শোষণের সাথে সমার্থক। এইসব চিন্তা থেকেই সাদিরের পুরুজ্জীবন নিয়ে নানান চিন্তাভাবনা আর অনুষ্ঠান হয়ে চলেছে – বিস্মৃতপ্রায় এই নৃত্যকলাটিকে ‘সম্মান’ জানিয়ে। কিন্তু সম্মান কথাটা বলতে যত সহজ, কাজে তার কতটা করে উঠতে পারি আমরা? একটি সাদির গানের সাথে নাচ শিখে তাকে মঞ্চে উঠে উগরে দেওয়া সহজ, কিন্তু এক অন্য সময়ের অপর নৃত্যশিল্পী, যাঁর সৌন্দর্যবোধ, শরীরবোধ, সৃষ্টির উদ্দেশ্য – সবই আমার তুলনায় ‘অপর’, তাঁকে সত্যি কীভাবে যথাযথ সম্মান দিতে পারি আমি?
যদি পুনরুজ্জীবনের মানে হয় সেই অপর শিল্পীর পূর্বাধিকারের, শিল্পভাবনার, ক্ষমতায়নের পুনরুজ্জীবন, তবে হয়তো সম্মান মানে তাঁকে বর্তমান সময়ে, সমাজে, অর্থনীতিতে প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা; খেলার মাঠের ‘সাইড-লাইনে’ ‘চিয়ার-গার্ল’ হিসেবে বসিয়ে রাখা নয়। যদিও মুত্থুক্কান্নাম্মলের মতো জাঁদরেল শিল্পীকে ঢাকঢোল পিটিয়ে ‘চিয়ার’ নৃত্য করার সুযোগ করে দিলে হয়তো আর বড় মাঠের খেলার দিকে চোখ ফেরানোই মুশকিল হয়ে দাঁড়াবে। সেও বেশ একখানা ভাববার মতো বিষয়!
Pingback: Visiting Mutthukkannammal, Revisiting Sadhir | parsleys