.
এক্কাদোক্কা, ২০১৯
১
তিনটে জিনিস হয়। শুরু, মাঝ আর শেষ। শুরু মানে তার আগে কিছু ছিল না। বা বলা যায়, তার আগে ছিল – ‘নেই’। তারপর মাঝ। মাঝ মানে বদল। এক বদল থেকে আরেক বদল, তার থেকে আরেক বদল। তারপরে একসময় বদলাতে বদলাতে, শেষ। তখন আবার সেই – ‘নেই’। কিন্তু এই নেই সেই নেই নয়। সেই নেই আর এই নেইয়ের মাঝে অনেক জল গড়িয়ে গেছে।
এই মাঝের বদল ঘটতে কতক্ষণ লাগে? মিনিট? ঘণ্টা? দিন? মাস? বছর? দশ বছর?
দশ বছরে কত কিছু বদলে যায়। স্কুলের চৌকাঠ পেরিয়ে ক্লাস ওয়ানে ঢোকা, আবার দশ ক্লাস পাশ করে সেই চৌকাঠ পেরিয়েই বেরিয়ে যাওয়া। ঠাকুমার একা একা সিনেমা দেখতে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়, তার জায়গায় সারাক্ষণ হাতে ঘোরে জপমালা। কাকার চাকরিতে বদলি হয়। দেশে এক সরকার পড়ে গিয়ে আরেক সরকার আসে। মাসতুতো দিদির গোলাপি চিঠি ঠিক জায়গায় পৌঁছে দিতে যাবার পথে মেসোর হাতে ধরা পড়ে প্যাঁদানি খাওয়া আর তারপর চেনা পাড়া-শহর ছাড়িয়ে ট্রেনে চেপে কনেযাত্রী হয়ে কতদূর চলে যাওয়া।
একটুখানি তর্ক থেকে চিরকালের জন্য কথা বন্ধ। বন্ধ হয়ে যায় দরজা, আর খোলে না। অথচ দেশে নতুন আইন হয়, যে কেউ কিচ্ছু গোপন করে রাখতে পারবে না, মনের সবচাইতে ভিতরের কথাটিও দরজা হাট করে জানিয়ে দিতে হবে। তাই যা কিছু তেমন গোপন করার নয়, তা-ও ভীষণ গোপন হয়ে উঠতে থাকে। মাথার উপর চাকরি চলে যায়, মাটির তলায় জল ফুরিয়ে যায়। আবার মায়ের নিজের হাতে লাগানো তুলসি চারা হামহাম করে গরুতে খেয়ে গেলেও পাশ দিয়ে নতুন চারা গজিয়ে ওঠে। নীলবাড়ির ঝলমলে নতুন বউদির আঁচলে মাড় খসে হলুদের ছোপ লাগে, গায়ে ঘামের বোঁটকা গন্ধ উঠতে শুরু করে, কোলেপিঠে ক্যাংলা ছানা। ঝলমলে বউদির কাছ ঘেঁষে তার ঝলমলে বাপের বাড়ির বিশ বার শোনা গল্প শুনতে আর ইচ্ছে করে না।
তবে ফোনে কথা বলা যায়। আবার ফোনের সঙ্গে কথা বলা যায়। ফোনের মধ্যে ঘাপটি মেরে বসে থাকা গুগলকে হুকুম অব্দি করা যায়। এই গুগল, এটা কি বলে দে তো? গুগল, যা ওটার মানেটা খুঁজে আন। ঠিক যেন ম্যাজিক। রূপকথা। তা’বলে কি যা ইচ্ছে হুকুম করা যায়? যেমন রাশিয়ান রূপকথায় ছোট ইভান তার হাতুড়িকে ডেকে বলত – “মাছের আজ্ঞায়, মোর ইচ্ছায়, যা হাতুড়ি রাজার সৈন্যদের পিটিয়ে আয়…” সেইরকমও?
হ্যারি পটার সাতানব্বই সালে ম্যাজিক-স্কুলে ভর্তি হয়ে ইউ-নো-হু-র ভয়ে জুজু হয়ে থাকত। দশ বছর পর, সাত সালে এসে, যাদুযুদ্ধে সে-ই হারিয়ে দিল ভিলেনের সেরা ভিলেন ভলডেমর্টকে, আর সাত খণ্ড রামায়ণের মতো ফুশ করে ফুরিয়ে গেল সাত খণ্ড হ্যারি পটার সিরিজ। এ-ও একরকমের দরজা বন্ধ হয়ে যাওয়া। আর কখনো হ্যারি-রন-হার্মিয়োনির সাথে ড্রাগনে চড়ে, ঝাঁটায় চড়ে, ফ্লু পাউডারে চড়ে ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ানো যাবে না। ইচ্ছে করলেও না। এরপর থেকে বেড়ানো মানে একা, বিনা ম্যাজিকে, পয়সা দিয়ে টিকিট কেটে।
দিন হোক, মাস হোক, বছর হোক, দশ বছর হোক, একশ বছর হোক – মোটের উপর এইসবই হয়। এক গল্প শেষ, আরেক গল্প শুরু। কোথায় শেষ, কোথায় শুরু, কোনটা শেষ, কোনটা শুরু – ভালোমতো বোঝাও যায় না। সত্যি ঘটনার সাথে শোনা কথা গুলিয়ে যায়। মন একরকম বলে, বাবা একরকম বলে, মা একরকম বলে, দিদি একরকম বলে, খবরের কাগজ একরকম বলে। কথার শেষ নেই। একই কথার আবার ঘুরিয়েফিরিয়ে কতরকমের মানে হয়। ফুল তো ফুলই। পদ্মফুল জলে জন্মায়, পুজোয় লাগে, পাতা পেতে ভাত খাওয়া যায়, নাল থেকে, বীজ থেকে ওষুধ হয় – এইটুকুই তো। অথচ মানে বদলে দিলে তার জ্বালায় দেশ কাবার।
বোগি আর রুমু – দুই ভাইবোন থাকত দিদিমার বাড়িতে। তাদের দেখাশোনা করত ঝগড়ু – গল্পের ঢিবি। সারাদিন মাঠেঘাটে ঘুরে বেড়াবার পর রাত্রে যদি ওদের পা ব্যথা করে উঠত, তখন শিরা-ওঠা হাতে মালিশ করে দিতে-দিতে ঝগড়ু ওদের গল্প বলত। আর ওরা সেসব গাঁজাখুরি বলে উড়িয়ে দিলে বলত – রুমুদিদি, বোগিদাদা, আসলে সত্যি যে কোথায় শেষ হয়, স্বপ্ন যে কোথায় শুরু হয়, বলা মুশকিল।
আসলে সত্যি আর স্বপ্নের কাউকেই ইচ্ছেমতো না শুরু করা যায়, না শেষ করা যায়। মাথা খুঁড়ে মরলেও সত্যি তার মতন করেই শুরু হয় আর তার মতন করেই শেষ হয় – ঠিক যেমনটি সত্যি-সত্যি হয়েছে। অজ-পাড়াগাঁয়ে মন খারাপ করা বউভাত বানচাল করতে গোলাপি চিঠি বুকপকেটে নিয়ে শাদা ঘোড়ায় চড়ে সত্যি করে আসে না কেউ। ঠাকুমা জপমালা হাতে মরে যাবার সময় তাঁর মোটা ফ্রেমের চশমার মতো বাহারি চোখ আর বুকে জপমালার মতো ছিটছিট দাগ নিয়ে জানলায় উড়ে এসে বসে না কোনো ঘুরঘুরে পোকা। কাকার চাকরির বদলি সত্যিই দূর থেকে আরও দূরের সব মফস্বল শহরে হতে থাকে। নীলবাড়ির নতুন বউদির ক্যাংলা ছানা যদি সত্যি স্কুল-টুল না গিয়ে কিসে জানি ভীষণ ভয় পেয়ে সারাটা জীবন চিলেকোঠার ঘরে ঘাপটি মেরে বসে থাকতে মনস্থ করে, তাতেই বা কে কি করতে পারে, আর যদি সত্যি সে কলেজ-টলেজ ডিঙ্গিয়ে পাকাপাকি অ্যামেরিকা পাড়ি দেয়, তার উপরেই বা কার কি বলার থাকতে পারে? কারণ সত্যি মানে তো সেটা হয়েই গেছে। তাকে আবার করে হওয়ানো বা অন্যভাবে হওয়ানো যায় না।
স্বপ্ন আবার এক কাঠি বাড়া। সত্যি যেমন আসবেই আর যাবেই, তাকে আটকানোই যাবে না। স্বপ্ন আবার আসবে কি আসবে না, এলেও কখন আসবে, যাবে কতক্ষণে, তা আজ অব্দি কেউ পাকাপোক্ত ভাবে বলে উঠতে পারল না। এদিকে নাকি চন্দ্রযান নাকি সূর্যযাননা তাই নিয়ে বিজ্ঞানীরা ফাটাফাটি করে দিয়েছে। ঘরে-ঘরে বই পড়ার আলো জুটুক না জুটুক, বন্দুক ছুঁড়লে নাকি আলোর ফোয়ারা বেরিয়ে এসে মানুষের বুক ফুটো করে দিতে পারে। সেই যে একজন একখানা গল্প লিখেছিল, যে দুই ভাই কেমন টিউব লাইট চিরে আলোয় ঘর ভরে তাতে নৌকো ভাসাতে ভাসাতে শেষে বেখেয়ালে ডুবে মরে গেল – সে কি তাহলে গল্প না?
যাই হোক, কথা হচ্ছিল স্বপ্নের। তা স্বপ্ন আসেও যদি, যদিও আসবে কিনা তার কোনো ঠিকঠিকানা নেই, এসে হয়তো বেখাপ্পা ভয় দেখিয়ে গেল। বা বেশ মন ভালো করছিল, হঠাৎ মোড় ফিরিয়ে ভীষণ দুঃখ দিয়ে দিল। যেমন একটা স্বপ্ন মাঝেমধ্যেই দেখতেন আমার পরিচিত একজন পশুপ্রেমী। দেখতেন, একটা অ্যাকোয়ারিয়াম কিনেছেন, তাতে ভারি সুন্দর রঙিন রঙিন মাছ ভরে রাখছেন। তারপর সেই মাছেরা একটা একটা করে মরে যাচ্ছে, একটাকেও কিছুতেই বাঁচানো যাচ্ছে না।
হয়তো একলা দুপুর। জনমনিষ্যি নেই। চেয়ারে বসে হোমওয়র্ক করতে করতে চোখটা লেগে এসেছে। দেখছি ক্লাস টিচার গায়ে-মাথায় হাত বুলিয়ে বেস্ট এসে-র প্রাইজটা হাতে তুলে দিচ্ছেন। অমনি ঝট করে শুরু হয়ে গেল টেবিলের নীচে ময়াল সাপের সরসরানি, চেয়ারের পায়া বেয়ে এই উঠছে, এই উঠছে, এদিকে কে যেন দরজা ভেঙে ঢুকতে চাইছে ঘরে। সে কি বন্ধু না শত্রু? সাপের হাত থেকে বাঁচাতে এসেছে কি? নাকি সে-ই লেলিয়ে দিয়েছে সাপটাকে এই ঘরের মধ্যে? নাকি তার গল্প সম্পূর্ণ আলাদা? সে হয়তো আসলে দরজার ওধারে নেইই। অন্য কোথাও আছে। তখন আবার চেয়ারের পায়ায় আধ জড়ানো সাপটাকে রেখে, তার পিছু ধাওয়া করে বেমালুম কোনো নদীর ধারে, বা পাহাড়ের চুড়োয় কিম্বা শপিং মলে গিয়ে পড়া। আর সে কি অপূর্ব চাঁদের আলো তখন সে পাহাড়ের চুড়োয়! সেই যে সেই একবারই পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে বিন্দু-বিন্দু আলো জ্বলা একখানা রূপকথার মতো ভ্যালি দূর থেকেই দেখে ফিরে আসতে হয়েছিল, কাছে যাওয়া হয়নি, সেই ভ্যালিটাই দেখা যাচ্ছে না চুড়ো থেকে? কিন্তু ওইখানেই শেষ। স্বপ্নের কোনো দায় নেই সেই ভ্যালিতে কাউকে নিয়ে যাওয়ার। দায় নেই খালি নয়, যাবেই না। যাবে না তো যাবেই না। মাথা খুঁড়ে মরলেও…
তাই গল্প ভালো। গল্প অতো নিষ্ঠুর না। তার বেশ শুরুও আছে, শেষও আছে। গল্পের যেমন ইচ্ছেমতো ঠ্যাং কেটে দিয়ে অ্যামেরিকা যাওয়া আটকে দেওয়া যায়, তেমনি আবার চাইলে ইলাস্টিকের মতো লম্বা করে বিন্দু-বিন্দু আলো জ্বলা ভ্যালির একদম মাঝখানে, বনের ধারে পাহাড়ি ঝর্ণার নীচে চান করিয়ে নিউমোনিয়া অব্দি বাধিয়ে দেওয়া যায়। আর গল্পের মধ্যে সবচাইতে সুবিধাজনক হল রূপকথা। তাতে একটুও সত্যি বলবার দায় নেই, আর দায় যে নেই, সেটা একবার মেনে নিলে তো তখন প্রতিটা কথাই সত্যি আর প্রতিটা কথাই মিথ্যে। তখন আর চিন্তা নেই।
২
রূপকথা বলতে অবশ্য ইংরিজিতে যাকে বলে ফেয়ারি টেল – মানে পরীদের গল্প – তার কথাই খালি বলা হচ্ছে না। সব দেশে সব সমাজেই মুখে-মুখে একধরনের গল্প চলে আসছে, যা বিশেষ করে বুড়োবুড়িরা – আরও বিশেষ করে বুড়িরা বসে নাতিনাতনিদের শুনিয়ে আসছেন, কিন্তু যা আবার কাজ করতে করতে মা-বাবারাও হয়তো শুনতে ছাড়তেন না। আমরা সবাই জানি, এসব গল্পে পরী-উকুনেবুড়ি-রাজা-রাণী-বাঘ-কুমীর-শিয়াল-চড়াই-রাক্ষস-ডাইনি-যাদুকর-চাষী-বামুন-জেলে-চোর কিছুই বাকি থাকে না। যেকেউ খারাপ হতে পারে, যেকেউ হতে পারে ভালো। গল্পের চোখে সবাই সমান। তো সেইধরনের গল্পকে আমরা বলছি রূপকথা। যে কথা ইচ্ছেমতো রূপ নিতে পারে, কোনো বাধ্যবাধকতা নেই।
রূপকথা কিকরে শুরু হয়? এক সময়ে এক দেশে এক অমুক ছিল। সে অমুক এক আঁটকুড়ো রাজা হতে পারে, গরীব চাষী হতে পারে, লোভী ব্রাহ্মণ হতে পারে, ধূর্ত শিয়াল হতে পারে। ওইটুকুতেই একটা ‘নেই’ থেকে হঠাৎ একটা গোটা গল্পের চলা শুরু হয়ে গেল। আর কি দরকার? রূপকথার জন্য দরকার খালি একটা সময়, একটা দেশ আর সেসময় সেই দেশের বাস করে এমন একজন কেউ, যাকে নিয়ে বাঁধা হবে গল্প। পান্তাভাত, খোসা চচ্চড়ি, কাঁটার ডাল – এইসব ঝড়তিপড়তি দিয়ে সংসার চালিয়ে যাঁদের হাত পাকা, তাঁদের গল্প চালাতে ওইটুকুর বেশি মালমশলার দরকার হয় না।
তবে রূপকথার গল্প যে কল্পনা দিয়ে তৈরি, সেই কল্পনার শুরুটা হয়তো একটা সত্যিতে, বা একটা স্বপ্নতে। আঁটকুড়ো রাজা তো সত্যিকারের হতেই পারে। জন্তুজানোয়ারের ধূর্ততা বা বোকামিও চোখ খোলা রাখলেই চোখে পড়ে। আবার হয়তো টুকরো টুকরো স্বপ্ন একজোট করে কেউ একটা রূপকথা বানিয়েছিল আর সেটাই মুখে-মুখে চালু হয়ে গেছে। ঠাকুর পরিবারে বাচ্চারা একবার নিজেরা মিলে একটা স্বপ্নের খাতা বানিয়েছিল – সবাই তাতে নিজের নিজের স্বপ্ন লিখে রাখত। অবনীন্দ্রনাথের কিছু কিছু রূপকথার গল্প নাকি সেইসব স্বপ্ন থেকে নেওয়া।
রূপকথা কিকরে শেষ হয়? আমি একজনকে চিনতাম, যে সারাক্ষণ হাবিজাবি গল্প বানাত, আর তার সব গল্পই শেষ হত এইভাবে, যে তখন সে গোবরে আছাড় খেয়ে পড়ে গেল। আর একজন কথক ভয়ের গল্পের শেষে এমন চেঁচিয়ে উঠত, যে যারা গল্প শুনছে, তাদের মাথা জানলায় ঠুকে একশা কাণ্ড। আরেকজন আবার গল্পের শেষ লাইনটুকু বলে একদম চুপ করে যেত। যেন কিছু একটা মনে পড়ে গেছে। ভাবটা এইরকম, যে এটা গল্পই ছিল তো? নাকি সত্যি? আগেকার দিনে সিনেমায় গোটা গোটা করে লিখে দিত –
‘দি এন্ড’
যাতে কারুর আর কোনো সন্দেহও না থাকে।
যারা গল্প বলে, বা লেখে, বা ভাবে, তাদের গল্পের শেষটা নিয়ে খুব জমিয়ে ভাবতে হয়। কারণ একবার শুরু হয়ে গেলে তখন গল্প বেশ গড়গড় করে চলতে পারে, তখন আর তার চলাটা তত চিন্তার বিষয় নয়, তখন চিন্তা তাকে থামাই কিকরে? বা ঠিক কোন সময়ে থামাই? যেমন সাইকেল চালানোর সময় হয় আর কি।
এ কে রামানুজন বলে একজন ছিলেন, যাঁর খুব রূপকথা শোনার, পড়ার আর লোককে ডেকে শোনাবার, পড়াবার বাতিক ছিল। তিনি এই রূপকথা শুরু আর শেষ হওয়ার ব্যাপারটাকে সেই স্কুলের চৌকাঠ পেরোবার মতো করে দেখেছেন। একজন ভালো গল্প বলিয়ে যখন গল্প বলেন, তখন যারা গল্প শুনছে, তারা ‘এক দেশে এক…’ শোনা মাত্র চৌকাঠ পেরিয়ে সেই দেশে গিয়ে পড়ে। তাই গল্প যখন মাঝসমুদ্রে বদলের পর বদলের ধাক্কায় টলমল করতে-করতে শেষের মাটিতে গিয়ে পৌঁছয়, তখন গল্প শুনিয়েদের ঝপ করে আবার চৌকাঠ পেরিয়ে বার করে নিয়ে আসতে হয়। রামানুজন বলেছেন, একবার গল্পটা বলে ফেলার পরে রূপকথা আর তাই নিয়ে ভ্যাজভ্যাজ করার দায় নেয় না, যে কি হল, কেন হল, এর থেকে আর কি কি হতে পারে। তাই আঁটকুড়ো রাজার পুত্রের গতি হওয়া বা ধূর্ত শিয়ালের উচিত শিক্ষা হওয়ার পর তার আর কিছু বলার থাকে না। তাই,
‘আমার কথাটি ফুরলো, নটে গাছটি মুড়লো’,
নয়তো,
‘এই গল্পটা আগে শুনেছিলাম আমি, এবার শুনলে তোমরা’,
নয়তো,
‘তখন তারা গেল তাদের দেশে, আর আমরা ফিরে এলাম আমাদের দেশে’।
মোদ্দা কথা – দি এন্ড। তখন আর ক্যান রে নটে মুড়োলি বলে কান্নাকাটি করে লাভ নেই। দিদিমার হয়তো ততক্ষণে নস্যি নিয়ে ঘুমোবার সময় হয়ে গেছে। নাতিনাতনিদেরও দুধ খেয়ে ঘুমোতে যাবার ডাক পড়েছে। আরব্যরজনীর রূপকথার কথক শেহেরজাদী রাত ফুরোলেই গল্প বন্ধ করতেন, বাকিটা আবার অন্ধকার নামলে। সে-ও একরকমের গল্প শেষ করবার কায়দা – যাতে গল্পটা শেষ হয়েও শেষ হয় না, সব নিয়ে ছটফটানিটুকু রেখে যায়।
মজা হচ্ছে, সব দেশে তো আর নটে গাছ নেই, তাই এক-এক দেশের মানুষ রূপকথা শেষ করবার এক-একরকম ফিকির বার করেছেন। অসমের কোনো কোনো রূপকথা শেষ হয় এইভাবে, যে
‘তারপর তারা সুখে ঘরকন্না করতে লাগল। এদিকে আমাদের বিস্তর কাপড় ধোওয়ার ছিল, তাই আমরা বাড়ি চলে এলাম।‘
আমরা মানে কিন্তু গল্পের চরিত্ররা নয়। যে গল্প বলছে আর যারা শুনছে। ইশ! কোথায় হচ্ছিল একটা লোম খাড়া করা গল্প, নিয়ে এনে ফেলল কাপড় কাচাকুচির মধ্যে। কিন্তু তা বললে চলবে কেন? চৌকাঠের ওপারে নাহয় রূপকথার রাজ্য, এপারে তো কাপড়চোপড় কাচতে হবে! ঝগড়ু হলে হয়তো বলত, রূপকথা কখন শেষ হয়, আর সত্যি কখন শুরু হয়…
আবার উড়িষ্যা থেকে পাওয়া এক রূপকথায় রাজারাণীর জমজমাট ভালবাসার গল্প শেষ করে গল্পের কথক বলে বসেন,
‘তারপর একদিন বাজারে গিয়ে আমার সাথে সেই রাজপুত্রের দেখা হল, কিন্তু সে তখন আর আমার সাথে কথাই বলল না।‘
তা চৌকাঠের এপারে কি রাজপুত্ররা যার-তার সাথে কথা বলে?
আমাদের রামানুজনের মতো সিসিলিতে জ্যুসেপ্পে পিতর বলে একজন রূপকথা জমাতেন। তাঁর জমানো অনেক গল্পই শেষ হত এইভাবে –
‘তারপরে তারা তো সুখে ঘরকন্না করতে থাকল, এদিকে আমরা দাঁত কিটকিট করে মরছি।‘
এই সুখে ঘরকন্না করার কথা দিয়ে অনেক রূপকথা শেষ হয়। ইংরিজিতে তাকে বলে
‘অ্যান্ড দেন দে লিভড হ্যাপিলি এভার আফটার’
বাংলায় ঠিক সারাজীবন সুখের গ্যারান্টি না দিলেও এই সুরে নানান রকম বলার ভঙ্গী আছে। যেমন ঠাকুরমার ঝুলির একটা গল্প শেষ হয় এইভাবে –
‘বামনি হেসে কুটি কুটি / মনের সুখে পতিসেবা করিতে লাগিলা সুখে সতী’
বা হয়তো এক সরোবরে এক ভয়ানক কুমীর ছিল। গল্পের শেষ লাইনে জানা গেল, সে সরোবরের জল এখন মানুষ ‘কলসে কলসে খায়’। বা এক গ্রামে খালি দুঃখী মানুষেরা থাকত, যারা একে অন্যকে হিংসে করে দিন কাটাত। গল্পের শেষে সেখানে আর কোনো দুঃখী, মূর্খ, হিংসুক রইল না। মোট কথা, গল্প শুনিয়েদের মনে যেন আর দুশ্চিন্তা না থাকে। তারা যেন নিশ্চিন্তে গল্পের চৌকাঠ পেরিয়ে সত্যির কাছে ফিরে আসতে পারে (সত্যি?)। মনের আধখানা চৌকাঠের ওপারে রয়ে গেলে যে কতরকমের সর্বনাশ হতে পারে!
এই সুখে ঘরকন্না করা নিয়ে অবশ্য রূপকথা তৈরির দুনিয়াতেই বারবার প্রশ্ন উঠেছে। বিশেষ করে আধুনিক সিনেমায় যখন রূপকথা তৈরি করা হয়েছে। নিশ্চিন্ত সুখের প্রতিশ্রুতির বদলে তাতে দেখা যায়, নায়ক-নায়িকারা গোটা সিনেমা জুড়ে একখানা ঘোর বিপদ কাটিয়ে ঘাম-টাম শুকিয়ে বাড়ি ফিরে যাওয়ার পরে, কোনো এক অন্ধকার বাড়ির কোণে আবার জন্ম নিচ্ছে আরেক ঘোর বিপদ। যেমন দেখানো হয়েছিল জুরাসিক পার্ক সিনেমায়। সেভাবেও রূপকথা শেষ হতে পারে। সুখে ঘরকন্নার মাঝে একফোঁটা চোনা রেখে দেওয়া।
আবার অন্যদিকে সুখে ঘরকন্না বিষয়টা যে একটু একপেশে, সেটাও খেয়াল রাখতে হবে। গল্পের হিরোরা নাহয় সুখে ঘর করতে লাগল। যারা হিরো নয়, তাদের কি হল? তারা কি দাঁত কিটকিট করেই ম’ল? সত্যির চোখে যেমন সবাই মোটেই এক না, রূপকথাও কি এই দিক থেকে দেখলে সবাইকে ঠিক সমান বলে মানে না?
সব রূপকথার শেষে অবশ্য গল্পের হিরোর সুখে ঘরকন্না করা হয় না। যেমন শিয়াল পণ্ডিতের গল্পে নাকের বদলে নরুণ, নরুণ দিয়ে হাঁড়ি, হাঁড়ি দিয়ে কনে, কনে দিয়ে ঢোল খরিদ করে সেই ঢোল বাজাতে বাজাতে শেষকালে আনন্দে নেচে উঠতেই শিয়াল তালগাছ থেকে নীচে পড়ে – বাঃ! তেমনি আবার ইটালির লিটল জনের গল্পে লিটল জন ছিল ভয়ানক সাহসী। সাহসের বলে টাকাপয়সা, রাজ্য, রাজকন্যা সব জয় করে সুখে দিন কাটাতে কাটাতে তার কি হল? না একদিন ভুলে পিছন ফিরে নিজের ছায়াটা দেখে সে এমন ভয় পেল, যে তখনই মাটিতে পড়ে মরে গেল। রুমেনিয়ার এক রূপকথায় রাজপুত্র সারাজীবন বীরের মতো মৃত্যুকে ঠেকিয়ে রেখে, শেষে থুত্থুড়ে বুড়ো হয়ে রাজ্যের লোকের মুখনাড়া খেতে-খেতে এক পুরনো কফিনে ঘাপটি মেরে থাকা মৃত্যুর হাতে ধরা পড়ল। ডেনমার্কের ছোট্ট জলকন্যার গল্পে, জলকন্যা ডাঙার রাজপুত্রকে ভালবেসে শুধু যে শরীরে-মনে ভয়ানক কষ্ট পেল, তা-ই নয়, শেষকালে মরে গিয়ে সাগরের ফেনাই হয়ে গেল। আবার কলাবতী রাজকন্যা, যাকে তার নিজের ভাই বিয়ে করবে বলে পাগল হয়ে উঠেছিল, সে কলার ভেলায় চড়ে মাঝনদীতে পালিয়ে –
‘ভাই হয়ে স্বামী হবেন এই আমার ভাগ্য / কলাবতীর ভেলা যেন এবার ডুবে যাক গো’
বলতে বলতে সেই যে ভেলা সমেত ভুশ করে ডুবে গেল, আর উঠল না।
কোনো কোনো রূপকথা আবার শেষ হয় গল্পের ভিলেনের ভয়ানক শাস্তির কথা দিয়ে। তাতে অবশ্য আশ্চর্যের কিছু নেই। কারুর শাস্তির না হলে কি অন্য কারুর সুখ হয়? তাই দুষ্টু রাণীদের হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়ে জ্যান্ত পুঁতে ফেলার পরে তবে গিয়ে সাত ভাই চম্পা এক বোন পারুলের রাজত্ব কায়েম হয়। ডাইনি দাসী কাঁকনমালা সূঁচের জ্বালায় ছটফট করতে করতে মরে যায়, তবে না রাজা, রাখাল আর কাঞ্চনমালার সোনার সংসার বসে। রেড রাইডিং হুডের আদি গল্পে নেকড়ে বাঘের পেটের মধ্যে পাথর পুরে সেলাই করে দেয় কাঠুরে, আর জ্ঞান ফিরে পেয়ে নেকড়ে বাঘ জলের তেষ্টায় পুকুরে নামতেই পেটের পাথরের ওজনে ডুবে মরে যায়। তেমনি গ্রিম ভাইদের আদি রূপকথায় স্লিপিং বিউটির ঘুম ভাঙ্গে তার টুকটুকে রাজপুত্র বরের চুমুতে নয়, যে বুড়ো রাজা তাকে ঘুমন্ত অবস্থায় জোর করে বিয়ে করেছিল, তার বাচ্চা বিয়োতে গিয়ে। রূপকথার শেষে এমন সব ভয়ানক ব্যাপার দেখে না ভেবে পারা যায় না – এসব কি গল্প? নাকি সত্যি? নাকি স্বপ্ন – দুঃস্বপ্ন?
হয়তো সত্যি আর স্বপ্নের মতো গল্প-রূপকথারও নিজের হাত-পা আছে। তারা আমাদের হাতের পুতুল সেজে থাকে বটে, কিন্তু আসলে আমরা তাদের বানাই, না তারা আমাদের দিয়ে নিজেদের বানিয়ে নেয়? হয়তো পিছন থেকে এক ঠেলা দিয়ে শুরু করিয়ে নেয়, আর সামনে থেকে এক ধাক্কা দিয়ে শেষ। কে বলতে পারে? তোমাদের মধ্যে যাদের বাড়িতে সেইসব ম্যাজিক ফোন আছে, তারা গুগলকে এ কথাটা জিজ্ঞেস করে দেখো তো? আহা যদি এটুকুও না বলতে পারে, তাহলে ওকে দিয়ে কোন্ কাজটা হবে শুনি?