(আয়নানগর বইমেলা ২০১৫)
নাচে ছুঁলে কয় ঘা?
আর কতদিন নেচে নেচে বেড়াবি? ওহ নাচেন বুঝি, আর কাজ কি করেন? ষষ্ঠীর দিন মেয়েটা নাচলো দেখলি, পুরো শিল্পা শেঠি! এঃ ব্যাটাছেলে আবার নাচে নাকি! …
মানুষমাত্রেই একা। নৃত্যশিল্পীরা মানুষ, অতএব নৃত্যশিল্পীরা একা। নাচে ছুঁলে ঘা কম নয়, কিন্তু সামান্যে কি তার মর্মে বোঝা যায়?
ভারতীয় মার্গীয় নৃত্যের একটি নিজস্ব ভাষা আছে, যেটা আমাদের পরিচিত বাচিক যোগাযোগের ভাষার মতই নিয়মে বাঁধা। একেকটি শব্দের মত একেকটি মুদ্রার কিছু মানে রয়েছে। আর এই মুদ্রাগুলির – অন্তত মৌলিক একসেট মুদ্রার অর্থ বেশ চিত্রানুগ। যেমন হরিণের মুদ্রায় তিনটি আঙুল জুড়ে হরিণের সরু মুখটি আর দুপাশে দুটি আঙুল দিয়ে কান উঠে আছে, সাপের মুদ্রায় ছোবল – এইসব আর কি। এছাড়াও যোগাযোগের উপাদান হিসেবে আছে নবরস – শৃঙ্গার, ভয়, শান্তি, রাগ, লজ্জা-টজ্জা। এরপর আসে ওই মৌলিক মুদ্রা ও রসগুলির পার্মুটেশন-কম্বিনেশনে নির্মিত জটিল শব্দ ও বাক্য, যেমন হরিণ গাছের তলায় দাঁড়িয়ে আছে, সে সাপ দেখে ভয়ে আঁতকে উঠলো। আবার দুঃশাসন বোঝাতে একহাতে রাজার মুদ্রা, আরেকহাতে কুটিল সর্পমুদ্রা, সতীন বোঝাতে দুই হাতে নারী দেখিয়ে তারপর দড়ির ফাঁস দেখানো (আমি অবশ্য অভিনয় দর্পণ, হস্তলক্ষণদীপিকা, নাট্যশাস্ত্রটাস্ত্র – যখন যেটা মাথায় আসছে শুট করছি, কেউ ভুল ধরলেই কান ধরব) – এইভাবে ভাষাটা ডেভেলপ করে। অতএব দৈনন্দিন জীবনের সহজ এক্সপ্রেশনের কাজটা মার্গীয় নাচ দিয়ে অনেকটাই কভার করে ফেলা যায়। নাচের আদিযুগে পার্ফর্মেটরি স্টোরি-টেলিঙের জায়গা থেকে এই যোগাযোগের প্রয়োজন ছিল। কিন্তু মানুষ যেমন যোগবিয়োগে খুশি না থেকে ডিফারেনশিয়াল ক্যালকুলাসের পিছনে ছোটে, তেমনি নাচের ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে নৃত্যশিল্পীরা শরীরের সহজ অভিব্যক্তি ও কথোপকথনে খুশি থাকেননি। তাঁদের মধ্যে কেউ নাচ জিনিসটাকে জিমনাস্টিক হিসেবে দেখতে চেয়েছেন, কেউ রূপচর্চা, কেউ আবার দেখেছেন রাজনীতি বা দর্শন হিসেবে। নাচের সাথে আমার ব্যক্তিগত সম্পর্কের নয় নয় করে পঁচিশ বছর হয়ে গেল, তাই স্বাভাবিকভাবে আমারও স্টকে রয়েছে একটা দেখার ধরণ, বহু প্রশ্ন, কিছু উত্তর। বিশেষ করে গত দেড়-দুবছরে ইণ্ডিয়ান কনটেম্পরারি নাচের একটি শাখার সাথে যুক্ত থাকায় হালের অনেক প্রশ্নই উঠে এসেছে ওই জায়গা থেকে। এ লেখা সেসব নিয়েই। একে ভারতীয় আধুনিক নাচের ক্র্যাশ কোর্স হিসেবে ধরলে বিষম খাব, বলা ভালো – এটা ভারতীয় নাচ, বিশেষত আধুনিক ভারতীয় নাচ বিষয়ে আমার ব্যক্তিগত ধ্যানধারণার মিনি পাঁচালিবিশেষ। ফলে উদাহরণ যা দেব, মূলত আমার চর্মচক্ষে দেখা নাচগুলির থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করব। আরেকটা কথা বলে রাখা ভালো, হয়তো শিল্পী ও তাঁদের শিল্পকর্মের নাম না করেও অনেক ব্যাপার কথায় বুঝিয়ে দেওয়া যেত; তাও আমি লেখাটিকে একটু নামভারাক্রান্ত করেছি, যাতে কারুর যদি মনে হয় ইউটিউব বা অন্যান্য অনলাইন আর্কাইভে গিয়ে এই নাচগুলির কোনোটা বা এদের সম্বন্ধিত কোনো ভিডিও দেখবেন বা রিভিউ, অন্যান্য আলোচনা পড়বেন, তাহলে তার একটা সহজ সুযোগ থাকে।
এব্যাপারে ছোট করে একটা ব্যক্তিগত কথা বলি। ভারতীয় কনটেম্পরারি নাচের এক্সপ্রেশনে নানা রস উঠে আসতে দেখেছি, কিন্তু গুড কোয়ালিটি হাস্যরসের কিছু অভাব আছে মনে হয়েছে। এর একটা কারণ হতে পারে, যে ভারতের মার্গীয় নৃত্যশাখার সুগভীর শিকড়ের তুলনায় এই সাবজেক্টটা সবে ছড়াতে বা স্বীকৃতি পেতে শুরু করেছে। তাই একটা জিনিসকে আগাপাশতলা চিনলে যেমন তার ফর্মের মধ্যে থেকেই তার বোকামি-ছোটমি নিয়ে রঙ্গব্যাঙ্গ করা যায়, সেই অবস্থান এখনো তৈরি হয়নি। আরেকটা কারণ কি এই যে কনটেম্পরারি মানুষের জীবনে হাস্যরসের একটা জেনুইন ভাঁটা পড়েছে, আর তাই তার শারীরিক এক্সপ্রেশনও অমনি কঠোর? মানে কনটেম্পরারি নাচ বলতে যদি গোদাভাবে শারীরিক বিমূর্ততা বুঝি, ক্লাসিকাল নাচের কাহিনিধর্মিতার তুলনায়, তাহলে সেই বিমূর্ততার রসটি কি শুধুই গাম্ভীর্য্যের? হাস্যরসের কথাটা তুললাম কারণ এর অভাবটা — আমার অনেক সময় মনে হয়েছে — কনটেম্পরারি নাচ ও ‘সাধারণ মানুষে’র মধ্যে একটা দেয়াল হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। যাই হোক, এ নিয়ে আর কথা বাড়াবনা। এমনিতেই পেশায় ও ভাবভঙ্গীতে শুষ্ক একাডেমিক হয়েও তুলকালাম নাচের নেশায় ডান্স-ফিল্ডের যত্রতত্র ট্রেসপাস করার সুবাদে নাচের লোকেরা আমায় একটি নিরীহ কিন্তু উদ্ভট জীব বলে গণ্য করেন। এই ধরুন, আমি যখনই কাউকে নাচের লাইনের কায়দা মত শত্রুমিত্রনির্বিশেষে কদিন বাদে বাদে দেখা হলে হাগ করতে কি হাগিত হতে যাই, তখনই ইনেভিটেবলি কোন দিকে মুখটা রাখতে হবে সেব্যাপারে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকি আর প্রত্যেকবার সেই কলেজফেস্টে লাইটম্যান জলধরদাকে বাই মিস্টেক গণ্ডে পেক করার কেস হয়। এইরকম আরো নানান ছোটবড় হাস্যকর ডেকোরাম খিচাইন আমার লেগেই থাকে। আবার সেদিন আমার এক নৃত্যশিক্ষক স্নেহের সাথেই ডেকে আমায় বললেন — জানিস তো আমাদের নতুন প্রোডাকশনটা নামছে, সবার সব ঠিক করা হয়ে গেছে কে কি করবে, তা তুই কি একটা কিছু করবি? তাতে অন্তত পুরো বিষয়টার একটা কমিক রিলিফ হবে, সবাই সিরিয়াস কাজ করছে তো…
রুস্তম ভারুচা যেমন নিজেকে কনটেম্পরারি নৃত্যশিল্পী চন্দ্রলেখার নাচের জগতের ‘ক্রিটিকাল ইনসাইডার’ বলেছিলেন, আমিও হয়তো তেমনি যে নাচের মানুষগুলির গায়ে লেপ্টে থাকার চেষ্টা করি, নিজেকে তাঁদেরই নৃত্যজগতের ‘জেস্টিং ইনসাইডার’ বলে ভাবতে পছন্দ করি। লেখার মুডটিও তাই একটু ভাঁড়ামি-ঘেঁষা বলে মনে হতে পারে। আমার জীবনের সবচেয়ে ভীতিপ্রদ শিক্ষক, শৈশব থেকে শুরু করে দীর্ঘ পনের বছর যাঁর স্নেহের মিঠেকড়া স্বাদ নিতে নিতে নাচের অ-আ-ক-খ শিখেছি, তিনি এ লেখা পড়লে গোল গোল চোখ করে তাকাতেন — এই সম্ভাবনার বিষম দায় ঘাড়ে নিয়ে লেখা শুরু করছি।
Continue reading →