ছেলেধরা ঘুরছে !

 

গ্রাউন্ডজিরো, ২০১৯

প্রতি বছরের কোনো এক সময়, ভারতে আবার নতুন করে ছেলেধরা বা বাচ্চা চুরির ভিত্তিহীন গুজব রটে। গুজবের শিকার হয়ে গণপিটুনিতে প্রাণ হারান বা শারীরিক ও মানসিক ভাবে লাঞ্ছিত হন শতাধিক মানুষ। সোশ্যাল মিডিয়ার বাড়বাড়ন্ত হওয়ার সাথে-সাথে এজাতীয় গুজব আরও দ্রুত, আরও বেশি জায়গা জুড়ে ছড়িয়ে চলেছে। এবছরও মে মাস থেকে এই গুজব দেশ জুড়ে ভয়াবহ আকার নিয়েছে। এক-এক রাজ্যে এক-একটি ঘটনার পর পুলিশ দলে-দলে – কোথাও ১০ জন, কোথাও ৫০ জন, কোথাও ৮০ জন সাধারণ মানুষকে গ্রেপ্তার করেছে, যে সাধারণ মানুষেরা দল বেঁধে এক বা একাধিক তাঁদেরই মতো সাধারণ মানুষকে বিনা দোষে পিটিয়ে মেরেছেন। পুলিশ প্যাট্রোল বাড়াচ্ছে, সিসিটিভি লাগাচ্ছে, মানুষের মধ্যে গুজব দূরীকরণ মেসেজ পাঠাচ্ছে, মিটিং করছে, কড়া শাস্তির ভয় দেখাচ্ছে, কিন্তু অবস্থা নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না। গত বছর সুপ্রিম কোর্ট থেকে ছেলেধরার গুজব ছড়িয়ে গণপিটুনির কেসে কড়া ব্যবস্থা নেওয়ার কথা বলে গাইডলাইন তৈরি করা হয়েছে, যাতে মার খেয়ে নির্দোষ কেউ মারা গেলে রাজ্য সরকারের তরফ থেকে ঘটনার ৩০ দিনের মধ্যে তার ক্ষতিপূরণের ব্যবস্থা করার কথাও বলা হয়েছে।

অন্যদিকে, উইমেন অ্যান্ড চাইল্ড ডেভেলপমেন্ট মিনিস্ট্রি জানাচ্ছে, এদেশে গড়ে প্রতি দশ মিনিটে একটি বাচ্চা হারিয়ে যায়। ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ডস ব্যুরোর ২০১৬-র হিসেব অনুযায়ী ওই বছর ৬৩,০০০-এরও বেশি বাচ্চা হারিয়ে যায়, তার মধ্যে ১৬ বছরের চেয়ে কম বয়সের ৮০০০ জন বাচ্চাকে তার মধ্যে কিডন্যাপই করা হয়েছে। এরা সকলেই দেশের ১৯টি বড় মেট্রোপলিটন শহরগুলির বাসিন্দা ছিল। প্রতি বছর এদেশে অগুনতি অপ্রাপ্তবয়স্ক শিশু ও কিশোর বেপাত্তা হয়ে যায়। ২০১৩-তে সুপ্রিম কোর্টের জারি করা আইনে হারানো বাচ্চার কেসে পুলিশকে বাধ্যতামূলক ভাবে এফআইআর নিতে বলা হয়ে থাকলেও, এনজিও-দের মত, পুলিশ বহু ক্ষেত্রে কেস নিতে চায় না, বাড়ির লোককে ফিরিয়ে দেয়। ৩০ অগাস্টের হিন্দুস্থান টাইমসের একটি রিপোর্ট জানাচ্ছে, এবছরের ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে সেইসব এলাকাতে, যেখানে আগে শিশু চুরির ঘটনা ঘটেছে। চুরি হয়ে যাওয়া শিশুরা সাধারণত দরিদ্র পরিবারের, এবং এদের মূলত বন্ডেড লেবার হিসেবে বা যৌনকর্মী হিসেবে কাজ করানোর জন্য চুরি করা হয়।

ভোপালে তোলা একটি প্রায় ৩ মিনিটের ভিডিও ফেসবুক ও হোয়াটসঅ্যাপের কল্যাণে ভাইরাল হয়ে পড়ে। তাতে একজন যুবককে একটি খুঁটিতে বেঁধে কয়েকজন মিলে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে বলে দেখা যায়। ভিডিওয় যুবকটি স্বীকার করে, সে একজন ছেলেধরা, এবং কয়েকজন বাচ্চাকে চুরি করে সে হোসেঙ্গাবাদে রেখেছে। অন্য নানা মিথ্যে করে বানানো ভিডিওর (যেমন, বাচ্চাদের কিডনি বার করে নেওয়ার জন্য অপারেশন করা হচ্ছে ইত্যাদি) পাশাপাশি পুলিশ এই ভিডিওটিকেও সাজানো বলেই সন্দেহও করছে। এইসব ভিডিও ব্যাপক হারে মানুষের ভিতর ছড়িয়ে যাচ্ছে। যে দেশে নাকি গোপনতম তথ্যটুকুও পুলিশের চোখ এড়ায় না, আপাত প্রমাণ না থাকলেও কোথা থেকে যেন খবর পেয়ে, মুহূর্তের তৎপরতায় সন্ত্রাসবাদীর তকমা দেগে তথাকথিত অপরাধীদের ধরে ফেলে পুলিশ, ব্লক করে দেয় অন্তত আপাত ভাবে আইন না ভাঙা ওয়েবসাইট, বাজেয়াপ্ত করে অন্তত আপাত ভাবে আইন না ভাঙা বই, সে দেশে সোশ্যাল মিডিয়ায় এইভাবে প্রহার ও হত্যার প্ররোচনামূলক খবর এত সহজে ছড়িয়ে যায় কিকরে? এই ব্যাপক হারে আহত ও মৃত মানুষেরা কি এদেশের নাগরিক নন? শুধুমাত্র শ’খানেক মানুষের শাস্তি হলেই কি এই সমস্যার, এই হিংসার সমাধান হয়ে যাবে? কি ঘটছে আমাদের সমাজে, যা একটা গোটা দেশের সাধারণ মানুষকে দল- কে-দল অপরাধী / হত্যাকারী বানিয়ে দিচ্ছে? দিয়েছে? দেয়?

ছেলেধরা ঘুরছে হরিয়ানায়

হরিয়ানার কথা দিয়ে শুরু করছি – তার কারণটা ব্যক্তিগত। গুরগাঁও শহরের এক-দু’টি বস্তি ও কলোনিতে বাচ্চাদের সাথে খানিক পড়া, খানিক খেলা – এইরকম অল্পস্বল্প কাজ করা কয়েকজন মানুষের সাথে আমার বছর দেড়েক আগে যোগাযোগ ঘটে। সেই সূত্রে এইসব বস্তি বা কলোনির বাসিন্দাদের সাথেও খানিকটা পরিচয় হয়। গত এক মাস ধরে এই বাসিন্দাদের ছোটবড় সবার মুখে শোনা যাচ্ছে, শহরে ছেলেধরার দল এসেছে। কখনো তারা নাকি অমুক গলি থেকে তিনজন বাচ্চাকে নিয়ে যেতে চেষ্টা করেছে, তার একজন কোনোক্রমে বেঁচে গেছে। কখনো তমুক মন্দিরের পিছন থেকে কোনো বাচ্চাকে তুলে নিয়ে গিয়ে তার উপর ভয়ানক অত্যাচার করা হয়েছে। খুবলে নেওয়া হয়েছে গালের মাংস, কিডনি বেচে দিয়ে ফেলে দিয়ে যাওয়া হয়েছে – এইরকম নানান কিছু। আর সবকিছুর সাথে প্রমাণ হিসেবে রয়েছে ঝাপসা কিছু ভিডিও – হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপ থেকে পাওয়া। কোথাও-কোথাও নাকি পুলিশ ফোন করে জানিয়েছে, যে বাচ্চাদের সামলে রাখা হোক, কারণ ছেলেধরারা ঘুরছে। কোথাও নাকি আবার কোনো মহিলা এসে ছেলেধরাদের গতিবিধির কথা জানিয়েছেন। জানিয়েছেন যে, তিনি কোনো এনজিও-তে কাজ করেন, তাঁদের কাছে খবর আছে, বাচ্চাদের যেন কিছুতেই একা না ছাড়া হয়। কে কথা বলেছে পুলিশের সাথে? কোন্‌ এনজিও-তে কাজ করেন সেই মহিলা? কে দেখেছে তাঁকে? কোনো পরিষ্কার উত্তর নেই। সে নিয়ে কে মাথা ঘামাবে? খবর যখন রটেছে, না-ই বা বেরোল সে খবর কোনো কাগজে বা টিভি চ্যানেলে। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডিজিটাল অক্ষরে লেখা হয়েছে। মানেই, ছেলেধরারা ঘুরছে।

অতএব অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো বাচ্চার – বিশেষ করে মেয়েদের। কারুর বাড়ি থেকে মানা, কেউ নিজেই যেতে রাজি নয় – একা-একা তো নয়ই। স্কুলে না গেলে পড়া জেনে নিতে অসুবিধা হবে না? না। এমনিতেই বা স্কুলে কী বা শেখা হয়? স্কুলের পড়া কি বোঝা যায় নাকি? বুঝতে না পারলে, বা ক্লাস মিস হয়ে গেলে, শিক্ষক বা সহপাঠীদের ধরে পড়া বুঝে নেওয়ারও চল নেই। ওদিকে আবার খুব জলাভাব যেসব বস্তিতে, সেসব বস্তির বাচ্চারা স্নান না করে স্কুলে গেলে শিক্ষক তাঁদের স্কুলে ঢুকতে বা ক্লাসে বসতে দেবেন কিনা, তারও ঠিক নেই। অতএব দিনমজুর যাঁরা, সঙ্গে করে কাজের জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন ছেলেমেয়েদের। নজরে রাখাও হবে, ছোটখাটো কাজ পেয়ে গেলে কিছু রোজগারও হবে। আমাদের এক স্বল্পপরিচিত রাজস্থানী বস্তিতে ছেলেধরার গল্পে ঘাবড়ে গিয়ে চারটে ঝুপড়ি খালি করে নাকি গ্রামেই চলে গেলেন এক পরিবার – সঙ্গে নানান ক্লাসে পড়া জনা চারেক বাচ্চা। যাবার আগে হাত জোড় করে বলে গেলেন, “আপনারা ক’দিন আসবেন না, লোকজন বড় ভয়ে আছে। অচেনা মানুষ বাচ্চাদের সাথে মিশছে, কথা বলছে দেখলে মেরেধরে তাড়িয়ে দিতে পারে…”

আমার পরিচিত যাঁরা ওই এক-দু’টি বস্তি-কলোনিতে কাজ করেন, তাঁদের অবশ্য কেউ ছেলেধরা বলে মারতে-ধরতে আসেননি। গোটা হরিয়ানা জেলাতেই এবছরের ছেলেধরা গুজব এখনো কোনো মৃত্যু না গুরুতর মারধোরের ঘটনা ঘটায়নি। তবে এক হরিয়ানভি যুবক আজাদ, ইউপির মীরাট জেলার শাজাহানপুরে জড়িবুটি বেচতে গিয়ে জনা পঞ্চাশেক স্থানীয় মানুষের হাতে বেধড়ক মার খান, যাদের মধ্যে বেশ কিছু বাচ্চাও ছিল, যারাও এতে হাত লাগাচ্ছিল। জানা যায়, হোয়াটসঅ্যাপে প্রচারিত কোনো একটি ছেলেধরার গুজবে দেখানো ছবির সাথে নাকি আজাদের মুখের মিল ছিল। আজাদকে মারার ঘটনার ভিডিওটি ভাইরাল হলে পুলিশ আটজনকে গ্রেপ্তার করে এবং গুজব ছড়ানোর বিরুদ্ধে কড়া শাস্তির ব্যবস্থা নেবে বলে জানায়। হরিয়ানার তিনজন পুলিশ আবার শাদা পোশাকে ইউপির লাখিমপুর খেরি অঞ্চলে গণপিটুনির শিকার হন, পরে স্থানীয় পুলিশ তাঁদের বাঁচায়।

ছেলেধরা ঘুরছে ইউপিতে

ইউপিতে মীরাটের নানা এলাকা, লোনি, শামলি, সম্ভাল, বুলন্দশাপুর, হাপুর, জৌনপুর, গাজিয়াবাদ, মথুরা, আমরোহা, উন্নাও, রায়বেরিলি, ঝাঁসি, দেওরিয়া ইত্যাদি বিভিন্ন এলাকা মিলিয়ে এক অগাস্টের শেষ সপ্তাহের তিন দিনেই ২০টি গণপিটুনির ঘটনা ঘটেছে, ছেলেধরা সন্দেহে। মোট ঘটনার সংখ্যা হয়তো ১০০ ছাড়িয়েছে, যদিও সঠিক পরিসংখ্যান বলা যাচ্ছে না। মার খেয়েছেন, লাঞ্ছিত হয়েছেন এবং মারা গেছেন বহু নির্দোষ মানুষ। এবছরের অগাস্ট ও সেপ্টেম্বর মাসে –

প্রহৃত হয়েছেন এক ঠাকুমা যিনি লোনি এলাকায় তাঁর নাতিকে নিয়ে দোকানে যাচ্ছিলেন;

আমরোহায় একজন মানসিক ভাবে অসুস্থ মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়েছে। তাঁর মৃতদেহ গ্রামের বাইরে টেনে ফেলে দেওয়া হয়েছে;

সম্ভালে প্রহৃত রয়েছেন দুই মধ্যবয়স্ক ভাই (রাজু ও রামাবতার), একজন আঘাতের ফলে মারাও গেছেন, আরেকজন এখনো হাসপাতালে। তাঁরা তাঁদের সাত বছর বয়েসী ভাইপোকে সঙ্গে নিয়ে তার জন্য ওষুধ কিনতে যাচ্ছিলেন। এক শারীরিক প্রতিবন্ধী মহিলাকেও মারধোর করা হয়েছে;

জৌনপুরে একই সন্দেহে এক মহিলাকে অর্ধনগ্ন করে গ্রামের ভিতর হাঁটানো হয়েছে;

হাপুরে মানসিক প্রতিবন্ধী মহিলাকে মারা হয়েছে;

মথুরায় এক ভিখিরি কালো কাপড় পরে থাকায় ছেলেধরা সন্দেহে তাঁকে মারধোর করা হয়েছে;

ইটাতে এক ৫০ বছর বয়স্ক হিমাচলী মহিলাকে, যাঁকে বাসে করে ইটা আসার সময় কেউ ওষুধ খাইয়ে অজ্ঞান করে দেয়, পুরুষ ও নারী স্থানীয় বাসিন্দারা অকথ্য মারধোর করেন;

মীরাটে বাজার যাবার পথে এক মহিলাকে ছেলেধরা সন্দেহে মারা হয়, তাঁর বোরখা ছিঁড়ে দেওয়া হয়;

কানপুরে তিনজন দরিদ্র শারীরিক প্রতিবন্ধীকে ছেলেধরা বলে মারা হয়। সাহিবে আলম নামে এক ব্যক্তির ব্যাগে একটি বোরখা পাওয়ার পরে (বোরখাটি তাঁর স্ত্রীর জন্য কেনা) তাকে বাচ্চা চোর বলে পেটানো হয়।

এরকম আরও বহু ঘটনা এবং প্রতিটি ঘটনাই ভয়াবহতায় ও নিষ্ঠুরতায় এক অন্যের সাথে পাল্লা দিতে পারে। হালে, দেওরিয়ার একটি গ্রামে একটি চোদ্দ বছরের ছেলেকে গ্রামবাসীরা ছেলেধরা সন্দেহে মারধোর করে। তার ক’দিন আগেই ওই এলাকায় ১৪৪ ধারা জারি করা হয়েছিল, কারণ এক যুবককে তাঁর বাবা-মা-ভাইয়ের সামনে পিটিয়ে মেরেছিলেন স্থানীয় কিছু মানুষ। জন্মাষ্টমীর দিনে বাজানো গানের আওয়াজ কম করতে বলা নিয়ে তর্কাতর্কি থেকে ঘটনা এখানে গড়িয়ে যায়। তো মিথ্যে ছেলেধরারা ধরা পড়ছে, মারা যাচ্ছে, কিন্তু বেশিরভাগ গণপিটুনির ক্ষেত্রেই দোষীদের সাজা হওয়া তো দূরের কথা, তাদের ধরাই যাচ্ছে না। ইউপিতে এখন অব্দি এতগুলি ঘটনা ঘটে গেলেও ১০০ জনেরও কম অ্যারেস্ট করা হয়েছে। ইউপির ডিজিপি জানিয়েছেন, দোষীদের বিরুদ্ধে এনএসএ (ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাক্ট) ধারায় চার্জ আনা হয়েছে এবং খুন, খুনের চেষ্টা, দাঙ্গা ইত্যাদির মামলা দায়ের করা হয়েছে। পুলিশের তরফ থেকে নাকি ভিডিও মেসেজও পাঠানো হচ্ছে, ছেলেধরার গুজবকে মিথ্যা বলে জানিয়ে। কিন্তু তার কোনো প্রভাব এখনো দেখা যাচ্ছে না।

ছেলেধরা ঘুরছে ঝাড়খণ্ডে

ঝাড়খণ্ডে ইতিমধ্যেই গৌ-রক্ষকদের হাতে গণপিটুনি খেয়ে মারা গেছেন বেশ কয়েকজন মানুষ। ছেলেধরা প্রসঙ্গেও ঝাড়খণ্ড পিছিয়ে নেই। আগস্ট মাসে অন্তত ৯ জন মানুষ মার খেয়ে মারা গেছেন। এই মাসেও এর মধ্যেই এজাতীয় ঘটনা ঘটে গেছে। ৪৪ জন মিথ্যে সন্দেহে ছেলেধরা বলে মার খেয়েছেন। রামগড়ে জনতার মার খেয়ে গুরুতর ভাবে আহত হয়ে একজন মাঝবয়েসী মানুষ রাঁচি হাসপাতালে ভর্তি হবার পর মারা গেছেন। এই রাঁচিতেই গৌ-রক্ষকদের মার খেয়ে মারা পড়েছিলেন আলিমুদ্দিন আনসারি, যাঁর হত্যাকারীদের জামিনে ছাড়া পাবার পরে মালা পরিয়ে অভ্যর্থনা করেছিলেন এক বিজেপি নেতা। গণপিটুনি যে একটা শাস্তিযোগ্য অপরাধ, এই এলাকায় মানুষ আর তেমনটা ভাবতে পারছেন কি?

একই সপ্তাহে, জয়নগরে বোনের বাড়ির যাবার পথে তিনজন আদিবাসী যুবককে ওই একই সন্দেহে পিটিয়ে মারা হয়। কয়েকজন পথযাত্রী, যাঁরা শুধুমাত্র এদের কেন মারা হচ্ছে বলে প্রশ্ন করতে যান – তাঁদেরও ওই সন্দেহে মারধোর করা হয়। পুলিশ আদিবাসী যুবকদের অ্যাম্বুলেন্সে তুলে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাবার চেষ্টা করলে তাঁদের অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামিয়ে আবার মারা হয়। ঝাড়খণ্ডের পুলিশের বক্তব্যও ইউপি পুলিশের মতোই।

ছেলেধরা ঘুরছে বিহারে

বিহারে (ইউপি, উড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি রাজ্যতেও) সাধারণ ভাবে বাচ্চা কিডন্যাপ, চাইল্ড ট্র্যাফিকিং ইত্যাদির হার বেশ উঁচু। আগস্টের ১ তারিখ থেকে শুরু করে বিহারে ৩০টিরও বেশি এজাতীয় ঘটনা ঘটেছে।

আগস্টের ২৫ তারিখ পাঁচজন বিভিন্ন বয়েসের মুসলমান এরকম একটি ঘটনার শিকার হন। তাঁরা একটি গাড়ি করে এক গ্রামের মুখিয়ার সাথে দেখা করতে যাচ্ছিলেন। সাথে ছিল তাঁদের একজনের ৮ বছর বয়েসী ছেলে – মোহাম্মেদ আয়ান। এই পাঁচজনই স্থানীয় সম্ভ্রান্ত পরিবারের সন্তান, একজনের দাদু স্বাধীনতা আন্দোলন ও খিলাফত আন্দোলনের কর্মী ছিলেন এবং বিহার সরকারের আইন বিভাগে কর্মরত ছিলেন। বাজারের কাছে ছেলেধরা বলে এই পাঁচজনের গাড়িতে পাথর ছোঁড়া হয় এবং তাঁদের তাড়া করে গাড়ি থেকে টেনে নামিয়ে মারা হয়। তাঁদের মুসলমান দেখে জনতা থেকে ‘মার মিয়া হ্যায়’, ‘হিন্দুস্থান জিন্দাবাদ, পাকিস্তান মুর্দাবাদ’ ইত্যাদি স্লোগানও দেওয়া হয়। আয়ান গাড়ি থেকে বেরিয়ে এসে দোষীদের আটকাতে গেলে সেও আহত হয়। স্থানীয় মুসলমানরা মারপিট থামিয়ে এঁদের আশ্রয় দিলে তাঁদের সন্ত্রাসবাদীদের সহায়ক বলে গালাগালি করা হতে থাকে। সন্ত্রাস কাকে বলে? এই ঘটনায় কে দেশবাসী আর কে সন্ত্রাসবাদী?

ছেলেধরা ঘুরছে সর্বত্র

রাজ্যগুলির মধ্যে এবছর ইউপি, বিহার, ঝাড়খণ্ড ইত্যাদি রাজ্যে ছেলেধরা সন্দেহে গণপিটুনি ও হত্যা(মব-লিঞ্চিং)-র ঘটনা সবচাইতে বেশি। দিল্লি, মহারাষ্ট্র, উত্তরাখণ্ড, আসাম, ত্রিপুরা, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাত, উড়িষ্যা, রাজস্থান, কর্ণাটক, অন্ধ্রপ্রদেশ, তামিলনাড়ু, পশ্চিমবঙ্গ, মণিপুর, হরিয়ানা ইত্যাদি রাজ্যেও একাধিক ঘটনা ঘটেছে – বহু ক্ষেত্রে প্রমাণপত্র বা পরিচয়পত্র থাকা সত্ত্বেও। বাচ্চার মা-বাবার অনুমতিক্রমে বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বেরনোর সময় মার খেয়েছেন কেউ কেউ।

জুলাই মাসে, ভোপালে কোটা গ্রামে এক রেলওয়ে ট্র্যাকে কর্মরত শ্রমিক ফোনে স্ত্রীর কাছে তাঁদের অসুস্থ বাচ্চার শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করছিলেন। যে গ্রামে তিনি তখন ছিলেন, সেখানকার মানুষ ফোনে তাঁর কথা শুনে তাঁকে ছেলেধরা সন্দেহে মারধোর করে। এরপর কি নিজের বাচ্চাকে সঙ্গে নিয়ে বেরোতে, বা ফোনে তাকে নিয়ে কথা বলতেও ভয় পেতে হবে এদেশের মানুষকে?

ছেলেধরা কে?

ছেলেধরা বলে কারা মার খাচ্ছেন? তারও একটা ধরন আছে। হয় এঁরা ‘বহিরাগত’, অর্থাৎ ওই এলাকার বাইরে থেকে আসা, হয়তো বা স্থানীয় ভাষা বলতে না পারা মানুষ – যেমন অধিবাসী শ্রমিক বা কোনো কোম্পানির কর্মচারী (দক্ষিণ ভারতে যেমন গত বছর একাধিক হিন্দিভাষী মানুষকে ছেলেধরা সন্দেহে মারা হয়)। নয় কারণটা ব্যক্তিগত প্রতিশোধ – অর্থাৎ কারুর উপর শোধ নিতে তার ছবি ছেলেধরা নামে সোশ্যাল মিডিয়ায় মেসেজ ছেড়ে দেওয়া এবং সেই মেসেজ ভাইরাল হয়ে যাওয়া। জুলাই মাসে পাঞ্জাবের বাতিন্ডায় এই অপরাধে ধরা পড়েছে একজন

সবচাইতে বেশি যাঁরা ছেলেধরা গুজবের শিকার হচ্ছেন, মারা পড়ছেন, তাঁরা সমাজের তথাকথিত নীচতলার মানুষেরা – নানা অর্থে। আর্থিক ভাবে নীচতলার, যেমন ভিখিরি, ফিরিওয়ালা ইত্যাদি – যেমন ইউপির একাধিক ঘটনায় দেখা গেছে। জাতিগত ভাবে নীচতলার, যেমন আদিবাসী ও অন্যান্য দলিত সম্প্রদায়ের মানুষ – যেমন জয়নগরের ঘটনা। ধর্মের দিক দিয়ে নীচতলার, যেমন মুসলমান, বিশেষ করে বিজেপি সরকারের শাসনকালে। এখনো সরাসরি মুসলমানদের লক্ষ্য করে হিংসাকাণ্ড শুরু হয়নি, কিন্তু বিহারের ঘটনায় পরিষ্কার যে এদুটি হিংসাত্মক ঘটনাকে মিলিয়ে দিতে উৎসাহী লোকের অভাব নেই; এর মধ্যেই রোহিঙ্গা মুসলমানদের দিকে ছেলেধরা বলে মিথ্যে অভিযোগের তীর উঠেছে। শারীরিক ও মানসিক ক্ষমতার দিক থেকে নীচতলার, যেমন প্রতিবন্ধী মানুষেরা – যেমন দিল্লীতে এক মূকবধির অন্তঃসত্বা মহিলাকে পেটানো হয়েছে, বা ইউপির নানা অঞ্চলে মানসিক প্রতিবন্ধী মানুষকে মারধোরের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। অন্যান্য রাজ্যেও আগের বছর বা তার আগের বছর এধরনের ঘটনার কথা শোনা গেছে। সমাজে সদস্যপদের সীমিত ও তথাকথিত সংজ্ঞার সাথে খাপ না খাওয়াতে পারা মানেই যেন সে ‘অপর’, তাকে মেরে ফেলা যায়। যাঁরা মার খাচ্ছেন, তাঁদের শ্রেণীর মানুষই আসলে সত্যিকারের বাচ্চা চুরির ক্ষেত্রে, বা সাধারণভাবে শিশুস্বাস্থ্য বা শিশুমৃত্যুর ক্ষেত্রে সবচাইতে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত।

আবার এর পাশাপাশি রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ার, শাদা পোশাকের পুলিশ, জিওলজিকাল সার্ভে অফ ইন্ডিয়ার কর্মচারী, আনন্দবাজার নিউজ টীম – বিচিত্র কারণে এমন মানুষেরাও এ যাত্রায় সন্দিহান জনতার হাতে মার খেয়েছেন, বা মার খাবার উপক্রম হয়েছে। কোনো যুক্তি, কোনো পরিচয়পত্র, কোনো মানবিকতাই মারমুখী জনতার কাছে বিবেচ্য বিষয় নয়।

ছেলেধরাকে ধরছে কারা?

যে ভিডিওগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় আসছে, তার বিষয় দুরকমের। এক, যেখানে ছেলেধরার মিথ্যে ঘটনা সাজিয়ে, মিথ্যে অভিনয় করে, অথবা ঘটনার সাথে একেবারেই জড়িত নয়, এরকম ছবি ও ভিডিওর সাথে ইচ্ছেমতো লেখা ব্যবহার করে বানানো ভিডিও, যা দেখিয়ে মানুষকে প্ররোচিত করা হচ্ছে। এর বেশ কিছু উদাহরণ রয়েছে। যেমন, ব্রেজিল বা পাকিস্তানের পুরনো শিশু চুরির ঘটনার ভিডিওর উপরকার লেখা পাল্টে, তাকে বর্তমান ঘটনার খবর হিসেবে দেখানো, দিল্লির হজরত মুহম্মদ স্টেশনে একটি ভারতীয় যুগলের বাচ্চা চুরির ঘটনাকে ভোপালে রোহিঙ্গা মুসলমানেদের বাচ্চা চুরি বলে দেখানো ইত্যাদি। এই মেসেজগুলিতে অনেক সময়ই যোগাযোগ করতে বলে ফোন নম্বর দেওয়া থাকে, বা থাকে লোকাল থানার নাম, যা এগুলিকে সাধারণ মানুষের কাছে আরও বিশ্বাসযোগ্য করে তোলে।

দ্বিতীয় যে ধরনের মেসেজ ফোন থেকে ফোনে ছড়িয়ে পড়ছে, তা হল সত্যি-সত্যি ঘটে যাওয়া গণপিটুনির ভিডিও। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই অপরাধীরা নিজেরাই ভিডিও তুলছেন এবং সোশ্যাল মিডিয়ায় তার প্রচার করছেন। প্রখ্যাত সাংবাদিক রবীশ কুমার কিছুদিন আগে ফিলিপিন্সে তাঁর ম্যাগসেসে অ্যাওয়ার্ড সভার বক্তৃতায় সাধারণ ভারতবাসীকে এই বলে অভিনন্দন জানান, যে সৎ সাংবাদিকতা বস্তুটি  তাঁরা অনেকেই নিজেদের জীবনে আপন করে নিয়েছেন – যে সততা মাইনে করা সাংবাদিকদের মধ্যে থেকে হারিয়ে গেছে। এই সৎ সাংবাদিকতা, যাকে রবীশ ‘নাগরিক সাংবাদিকতা’ বলছেন, মূলত ঘটছে ফোন ক্যামেরার মাধ্যমে।

রবীশ যে প্রসঙ্গে কথাগুলি বলেছেন, ছেলেধরা সন্দেহে মারার ঘটনার ক্ষেত্রে (বা গরুখেকো সন্দেহে মারার সময়, বা গণধর্ষণের সময়) সেই নাগরিক সাংবাদিকতার ক্ষমতার অন্ধকার দিকটি সামনে চলে আসে। প্রতিটি এজাতীয় ঘটনার ক্ষেত্রেই ফটো ও ভিডিও তুলে সোশ্যাল মিডিয়ায় ছড়িয়ে দেওয়ার মধ্যে রয়েছে মানুষের মনের এক ধর্ষকামী, হিংসুক, বিষাক্ত পুরুষতান্ত্রিক দিকটি (মারধোরের ঘটনায় বিভিন্ন জায়গায় পুরুষ-নারী-বাচ্চা সবাই অংশ নিচ্ছেন), যা কিনা দলবদ্ধ হয়ে হত্যায় গর্ববোধ করতে প্ররোচিত করে, ক্ষমতাশালী সংখ্যাগুরু হিসেবে ক্ষমতাহীন সংখ্যালঘুকে উচিত শিক্ষা দেবার গর্বে গর্বিত হয়। সোশ্যাল মিডিয়ার ভিডিও প্রচার তাদের জন্য সমাজের সামনে ক্ষমতার প্রদর্শনী।

আবার বর্তমান সরকারের তরফ থেকে যেভাবে রিলায়েন্স ও অন্যান্য নেটওয়ার্ক কানেকশনকে হয় হাত করে নয় দেউলিয়া করে ঘরে-ঘরে নানা প্রচারমূলক ভিডিও, ছবি ও লেখা পাঠানো হয়ে আসছে, বিজেপি আইটি সেল সোশ্যাল মিডিয়া সামলাতে যতটা তৎপর, তাতে প্রশ্ন উঠতে বাধ্য, যে এজাতীয় ঘটনায় ও তার প্রচারে বাধা দেওয়ায় কোনো ইচ্ছে সরকারের আছে কি না। বা অন্তত, এই প্রচার থামাবার ইচ্ছের ব্যাপারে সরকারের তরফে কোনো (ইচ্ছাকৃত?) ঘাটতি থেকে যাচ্ছে কিনা। হিংসা যত বাড়বে, তথাকথিত নীচতলার মানুষ যত বেশি করে মারা পড়বেন, দেশের সাধারণ মানুষ যত একে অন্যের থেকে আরও দূরে চলে যাবেন। এতে সুবিধা কার?

ছেলেধরার আসল র‍্যাকেটগুলিকে ধরা ও বাচ্চা চুরির প্রতিকার করা অনেক বেশি জটিল, কঠিন। তা নয়তো জাস্টিস ভার্মা কমিটির রিপোর্ট অনুযায়ী চাইল্ড ট্র্যাফিকিং-এর শিকার বাচ্চাদের যৌনকর্মী হিসেবে ব্যবহারকে অপরাধ বলে দাগিয়ে দেবার পাশাপাশি বন্ডেড লেবার বা দাস হিসেবে ব্যবহারকে এখনো অপরাধ বলে দাগিয়ে দেওয়া গেল না কেন? কেন নতুন শ্রমিক আইনে শিশু শ্রমিক ব্যবহারের অপরাধীকরণ ঘটল না? সামান্য ফাইনটুকু অব্দি কেন চাপানো হল না মালিকদের উপর? আসলে কিছু মানুষের বলি চড়িয়ে, সরকারি তরফে সত্যিকারের বাচ্চা চুরির প্রতিকারে শক্তি ব্যয় না করে, মিথ্যে প্রচারের মাধ্যমে দেশের মানুষকে নিজের হাতে আইন তুলে নেবার প্ররোচনা দেওয়া অনেক বেশি সহজ। একভাবে দেখতে গেলে, এ যেন বিজেপি সরকারের ‘অন্ত্রেপ্রনারশিপ নীতি’, অর্থাৎ সরকারি সাহায্যের ভূমিকা কমিয়ে স্ব-উদ্যোগে জীবনধারণ করার নীতিরই এক অংশ, যেখানে, এমনকি আইন-আদালতের কাজটাও সাধারণ মানুষকে এবার নিজেকেই করতে হবে! যে ক্ষোভ আসলে দলবদ্ধ ভাবে এই মানুষদের মনে জমে ওঠা উচিত সরকারের বিরুদ্ধে, ক্ষমতাশালী শ্রেণী ও জাতির বিরুদ্ধে, তাকে এইভাবে হালকা করে দেওয়া যাবে। দেশের মানুষদের ব্যবহার করা যাবে একে অন্যের বিরুদ্ধে, নিজেদেরই বিরুদ্ধে।  সরাসরি না হোক, ঘুরিয়ে।

কথা শুরু হয়েছিল গুরগাঁও নিয়ে। সেখানে স্বল্পপরিচিত একটি বস্তিবাসী রাজস্থানী পরিবারের কথা শুরুতে বলছিলাম, যাঁরা ছেলেধরার গুজব ছড়াবার পর বস্তি ছেড়ে চলে যান। তাঁরা বলে যান, তাঁরা আর শহরে ফিরবেন না। জানান, তাঁরা আদতে ‘উচ্চবংশীয়’, অর্থাৎ গ্রামে তাঁদের মানসম্মান আছে। ওদিককার, মানে ফুট পাঁচেক দূরে একই বস্তিতে বসবাসকারী বকরি-চরানেওয়ালাদের মতো নন তাঁরা – যদিও একই রাজ্যের মানুষ। কপালদোষে পাঁচরকম লোকের মাঝে বস্তিতে এসে পড়েছেন। যাক, সে পাঠ আপাতত চুকল। এখন থেকে তাঁদের বাচ্চারা গ্রামেই পড়াশুনো করবে। হয়তো। তাঁদের একটি ছেলে ভালো ছবি আঁকত, আরেকজন তরতর করে হিন্দি গল্প পড়ত, একটি মেয়ের মাথায় চমৎকার অঙ্ক খেলত। তাদের সাথে আর দেখা হবে না।

তা সে হয়তো ভালোই। শহরে টিকে থেকে এই বাচ্চাদের অধিকাংশই বিশেষ কিছু পেতে পারে কি? এদের বাবামায়েরা মূলত দিনমজুর, কাগজকুড়ানি বা ফেরিওয়ালা বা মুচির কাজ করেন। কেউ কেউ অটোচালকও, তাঁদের রোজগার হয়তো একটু বেশি। অনেকে বাচ্চারই বিয়ে দেওয়া হয়ে গেছে জন্মের অল্প কয়েক বছরের মধ্যে। একটু বয়েস হলেই গ্রামে ফিরে গিয়ে সেই ছোটবেলার বিয়ে ধরে বড়বেলার সংসার পেতে বসা। তারপর আবার শহরে আসা, প্লাস্টিক কুড়নো, দিনে দু’চারশ টাকার ইঁটবালি বওয়া, রাস্তা কাটা, চুন ফেলা, ঘর ঝাঁট দেওয়া-মোছা, ভর ছ’টা থেকে রাত আটটা। তারপর ঘরের কাজ, মদ, জমি থেকে পুলিশ-গুন্ডা লাগিয়ে উঠিয়ে দেওয়ার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা, শিশুর জন্ম দেওয়া, তাকে হারিয়ে ফেলার ভয়ে কাঁটা হয়ে থাকা…

শহরের ধুলোধোঁয়া আর বস্তির ঠিক সামনে দুর্গন্ধ-পাঁকময় আবর্জনা ফেলার বিস্তীর্ণ সরকারি জমি – এসব বাদ দিয়েও রয়েছে বিদ্যুৎ ও জলের সমস্যা। এই বিশেষ রাজস্থানী বস্তিটির মানুষজন আগে যে জমিতে বসবাস করছিলেন, সেখানে তাঁরা বিদ্যুৎ ও জল পেতেন, সরকারের সাথে কিছু একটা লেখাপড়াও ছিল – শুনে মনে হয়, হয়তো বা ‘রেকগনাইজড’ বা ‘আইডেন্টিফায়েড’ বস্তির মধ্যে পড়ত সেটা। কিন্তু কয়েক বছর আগে তাঁদের প্রায় জোর করে তুলে দেওয়া হয় – এক-এক পরিবারকে মাত্র ৭০,০০০ টাকা দিয়ে, যা দিয়ে এক বছরের গ্রাসাচ্ছদনও চলে না। তুলে দেন ওই অঞ্চলের ক্ষমতাশালী রাজনৈতিক নেতা। গুরগাঁও-এর মতো অধিবাসী শ্রমিক অধ্যুষিত শিল্পকেন্দ্রিক শহরে এরকমই হবার কথা। গত বছরের হাউজিং অ্যান্ড ল্যান্ড রাইটস নেটওয়ার্ক-এর সমীক্ষা অনুযায়ী গুজরাত ও মহারাষ্ট্রের পাশাপাশি হরিয়ানা রাজ্যে জোর করে গরীব মানুষের জমি কেড়ে নেওয়ার হার ছিল সবচাইতে বেশি। বিশেষ করে গুরগাঁওতেও উচ্ছেদের হার অন্য টিয়ার টু শহরের তুলনায় উপরের দিকে। শহরের অধিকাংশ জমি, যার অনেকটাই আসলে আবার সরকারি জমি, নিয়ন্ত্রিত হয় স্থানীয় নেতা বা অন্য কোনো তোলাদারের হাত দিয়ে। সাধারণত ক্ষমতাশালী জাঠ বা গুর্জরদের হাতে থাকে বস্তি বসানো, ওঠানোর সমস্ত ক্ষমতা। অন্যদিকে অধিকাংশ বস্তিবাসীই দলিত, বা মুসলমান – নোংরা, চোর, ভিখিরি – এই বলে পরিচয়। সাধারণত যে ধরনের মানুষের বাচ্চা চুরি গেল না রইল, তা নিয়ে সরকার বা অন্য কারুর তেমন মাথা ব্যথা থাকে না।

সত্যিই নোংরা। খাবার জলই র‍্যাশন করা, তো পরিষ্কার থাকার জল! কোনো কোনো বস্তিতে দু’তিন মাসে একবার ট্যাংকার আসে, বাকি সময় নিত্য মুখ নাড়া খেয়ে জল মেঙে বয়ে আনা। স্নান করবার ঢাকা জায়গা নেই, যদি না বস্তির ধারেকাছে সুলভ বাথরুম থাকে। পরিষ্কার থাকার সময়ও খুব নেই। সত্যিই ভিখিরি – বিশেষত বাচ্চারা, অন্তত যাদের এখনো ততো টনটনে সম্মানজ্ঞান জন্মায়নি। এদিক-ওদিক ঘুরে বেড়ায়, চেয়েচিন্তে পয়সা পেলে গুলি খেলে, হাবিজাবি ‘চীজ’ কিনে খায়। কেউ তুলে নিয়ে যেতে চাইলেও আটকাবার কেউ নেই। সত্যিই চোর। যে জমিতে ঝুপড়ি করে থাকে, সে জমির জবরদখলকারী মালিকদের মতো বড়সড় চোর নয় অবশ্য। দেড় বছর আগে মনোনীত হওয়া গুরগাঁও শহরে স্লাম-ইন-সিটু রিহ্যাবিলিটেশন প্রকল্প মাথায় নিয়ে হরিয়ানা সরকার ঘাপটি মেরে বসে আছে। আরবান লোকাল বডির ওয়েবসাইটে সে প্রকল্পের পাত্তা পাওয়া যাচ্ছে না। পাত্তা পেলেও, তার ভিতর ঢুকে আছে প্রকল্প শুরুর পিপিপি মডেলের চক্কর থেকে প্রকল্প শেষে মিউনিসিপালটির হাতে লাখখানেক টাকা দিয়ে অ্যালটমেন্টের দীর্ঘ ১৫ বছর পরে পেলেও-পাওয়া-যেতে-পারে ধরনের পাকা বাড়ির গল্প। এই প্রক্রিয়ার খাঁজে খাঁজে নানান খাতে যে মহাচুরির সম্ভাবনা, সাধারণ বস্তিবাসীরা তেমন চুরির ধারকাছ দিয়েও যেতে পারেন না। তবে কেউ কেউ চুরি করেন বই কি। বড়রা, ছোটরাও। সব রাজ্যেই ছবিটা মোটামুটি এক। অতএব গ্রামে গিয়ে পড়াশুনো করা, বা না করা, বা স্রেফ হারিয়ে যাওয়া হয়তো বা ভালোই – কে বলতে পারে!

কারণ ছেলেধরারা ঘুরছে। ভালর মধ্যে এই ছেলেধরাদের ধরা যায়, ধরতে পারলে মারা যায় – প্রমাণ পাওয়া যাক, বা না যাক। এটা দরকার, কারণ হাতের কাছে মারবার জন্য, মারাবার জন্য কাউকে দরকার। তাই ছেলেধরা, গরুখেকো, চোর-পকেটমার সমাজে অননুমোদিত সম্পর্কে লিপ্ত প্রেমিক-প্রেমিকা – যেখানে যে নামটা চলে, যার উপর যতখানি হাতের সুখ করে নেওয়া যায়। আসল প্রয়োজন, কখনো ভিন্ন ধর্মের, কখনো ভিন্ন জাতের, কখনো ভিন্ন শ্রেণীর, কখনো বা ভিন্ন সংস্কৃতির মানুষকে নানাভাবে উচ্ছেদ করা। এবং আরও গভীরে, অল্প কিছু ক্ষমতাবান লোকের রাজনৈতিক প্রয়োজন, সাধারণ মানুষকে একজোট হওয়া থেকে যতভাবে পারা যায় আরও দূরে সরিয়ে রাখা।

Leave a comment